মুঠোফোন প্রযুক্তির ব্যবহার মানুষের জীবনকে গতিশীল করেছে। পাশাপাশি এ মাধ্যমে গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার ঝুঁকিও বাড়ছে। অনলাইনে হয়রানির শিকার হওয়াটা এখন বড় উদ্বেগের বিষয়। সম্প্রতি বিশ্বের অন্যতম টেলিযোগাযোগ প্রতিষ্ঠান টেলিনরের এশিয়া কার্যালয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের অর্ধেক মাসে অন্তত একবার হলেও হয়রানি বা উৎপীড়নের শিকার হয়ে থাকেন।
‘টেলিনর এশিয়া ডিজিটাল লাইভস ডিকোডেড’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি টেলিনরের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে গত ৩১ অক্টোবর।
টেলিনর বলছে, মুঠোফোন ব্যবহারের মাধ্যমে অনলাইনে নতুন কোনো দক্ষতা শেখার ক্ষেত্রে কাজে দিয়েছে। বাংলাদেশের ৬৬ শতাংশ মানুষ আশা করেন, অনলাইনে শেখা নতুন কোনো দক্ষতা কাজের ক্ষেত্রে তাঁদের এগিয়ে নেবে বা নতুন কোনো কাজের সুযোগ তৈরি করবে।
অনলাইনে স্বাস্থ্যকর সামাজিক সংযোগ তৈরি, নতুন কিছু শেখা, আয়ের ক্ষেত্রে মুঠোফোন প্রযুক্তি কীভাবে ব্যবহৃত হয়, অনলাইনে সময় কাটানোর সঙ্গে যে ঝুঁকিগুলো আছে, সে ব্যাপারে মানুষের ধারণা এবং তা প্রতিহত করার উপায় জানা আছে কি না—এসব বিষয়ে একটি জরিপ পরিচালনা করেছিল টেলিনর এশিয়া। সে জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে এ প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশের শীর্ষ মোবাইল অপারেটর প্রতিষ্ঠান গ্রামীণফোনের প্রধান বিনিয়োগকারী টেলিনর।
চলতি বছরের আগস্টে টেলিনর এশিয়া বাংলাদেশসহ দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার আটটি দেশে মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্য থেকে ৮ হাজার ৮৭ জনের ওপর জরিপটি চালায়। বাকি সাতটি দেশ হলো ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, পাকিস্তান, ফিলিপাইন, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম। ১৮ বছর ও এর বেশি বয়সীরা জরিপে অংশ নেন। এতে বাংলাদেশের ১ হাজার ১১ জন ছিলেন।
টেলিনরের জরিপে দেখা গেছে, মুঠোফোন প্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের কাছে অনলাইন হয়রানি এখন বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং অনেকের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। জরিপে অংশ নেওয়া ৮ হাজারের বেশি ব্যবহারকারীর মধ্যে ১৭ শতাংশ বলেছেন, গত ১-২ বছরে তাঁরা প্রতি মাসে অন্তত একবার হলেও অনলাইনে হয়রানির শিকার হয়েছেন। আটটি দেশের মধ্যে মাসে অন্তত একবার অনলাইনে হয়রানির শিকার হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। এটি ৫০ শতাংশ।
অন্যদিকে অনলাইনে দিনে একবার হয়রানির শিকার হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি পাকিস্তানে (১১ শতাংশ)। এরপরই বাংলাদেশের অবস্থান। জরিপে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশিদের মধ্যে ৮ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা দিনে একবার হলেও অনলাইনে হয়রানির শিকার হন।
অনলাইনে সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হচ্ছেন তরুণেরা। জরিপে অংশ নেওয়া তরুণদের প্রায় ৭০ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা গত ১-২ বছরের মধ্যে অনলাইনে নেতিবাচক অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন। যাঁদের মধ্যে ৭৯ শতাংশ বলেছেন, এই হয়রানি তাঁদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর উল্লেখযোগ্য মাত্রায় প্রভাব পড়ার কথা বেশি বলছেন ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সী ব্যক্তিরা।
জরিপে অংশগ্রহণকারীরা পরিবারের বয়স্ক ও তরুণ প্রজন্মের অনলাইন নিরাপত্তা নিয়ে বিশেষভাবে উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৮১ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা কম বয়সীদের জন্য অনলাইনে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। এ উদ্বেগের হার ফিলিপাইনের মানুষদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি, ৬৫ শতাংশ। এর পরের অবস্থানেই আছে বাংলাদেশ। জরিপে অংশ নেওয়া ৫১ শতাংশ বাংলাদেশি বলেছেন, তাঁরা অনলাইনে কম বয়সীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
পাশাপাশি বয়স্ক ব্যক্তিদের অনলাইন নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগের কথা উঠে এসেছে। বাংলাদেশের ৩৪ শতাংশ মুঠোফোন ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বলেছেন, তাঁরা বয়স্ক ব্যক্তিদের অনলাইন নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন।
অনলাইনে নিরাপত্তা নিয়ে প্যারেন্টাল কন্ট্রোল, খোলামেলা আলোচনা, গাইডলাইন দেওয়া, অনলাইন বিচরণ পর্যবেক্ষণ করার মতো পদক্ষেপে বাংলাদেশের মানুষ খোলামেলা আলোচনা করতে বেশি আগ্রহী।
অন্যদিকে অনলাইনে দিনে একবার হয়রানির শিকার হওয়ার হার সবচেয়ে বেশি পাকিস্তানে (১১ শতাংশ)। এরপরই বাংলাদেশের অবস্থান। জরিপে অংশগ্রহণকারী বাংলাদেশিদের মধ্যে ৮ শতাংশ বলেছেন, তাঁরা দিনে একবার হলেও অনলাইনে হয়রানির শিকার হন।
মুঠোফোনের ব্যবহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ গোপনীয়তা ও নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। টেলিনরের প্রতিবেদনে বলা হয়, চলতি বছর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) বছর হিসেবে বিবেচিত। এআই মানুষের জীবনকে যেমন সহজ করেছে, তেমনি এর ঝুঁকিও রয়েছে।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের অর্ধেকের বেশি তাঁদের মুঠোফোনে বিভিন্ন সেবা ও অ্যাপ ব্যবহারের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা ও নিরাপত্তাকে বিবেচনায় নেয়। প্রতি ১০ জনের ৯ জনই বলেছেন, তাঁরা নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা নিয়ে চিন্তিত। বাংলাদেশের ৩৫ শতাংশ মানুষ মুঠোফোনের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন এবং ৫৫ শতাংশ মানুষ কিছুটা উদ্বিগ্ন।
এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের মানুষ তথ্য ফাঁস ও ফিশিং বা স্ক্যাম নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন। এ ক্ষেত্রে ফিলিপাইন শীর্ষে। অন্যদিকে বাংলাদেশের মানুষ ৫৪ শতাংশ তথ্য ফাঁস বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। ফিশিং আর স্ক্যাম নিয়ে ৪৩ শতাংশ বাংলাদেশি উদ্বিগ্ন।
ভুয়া খবর নিয়ে উদ্বেগ
অনলাইনে ভুয়া খবর নিয়েও এ অঞ্চলের মানুষ উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। সেখানে বাংলাদেশের অর্ধেকের বেশি ভুয়া খবর এবং প্রায় অর্ধেক পরিচয়–সংক্রান্ত প্রতারণা বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
মুঠোফোন ব্যবহারে দক্ষতার অভাবও নিরাপত্তাঝুঁকির কারণ বলে বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ মনে করেন। মুঠোফোনে নিরাপত্তার দায়ভারের প্রশ্নে অংশগ্রহণকারীরা বলেছেন, মুঠোফোন উৎপাদনকারী, টেলিকম প্রতিষ্ঠান, সরকার এবং ব্যবহারকারী—সবারই দায় আছে।
মুঠোফোন প্রযুক্তি ব্যবহারে হয়রানি, নিরাপত্তা, গোপনীয়তা নিয়ে উদ্বেগের পাশাপাশি এই প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে কতভাবে প্রভাবিত করেছে এবং পরিবর্তন এনেছে, সেটাও প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।
টেলিনর এশিয়া বলছে, বাংলাদেশের মানুষ দিনের ৫৮ শতাংশ সময় মুঠোফোনে সময় কাটান। দেশের ৭৭ শতাংশ মানুষ বলেছেন, মুঠোফোন ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাঁদের ভারসাম্য রয়েছে, অতিরিক্ত ব্যবহার করা হয় না। তাঁরা বলছেন, পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কন্নোয়নের ক্ষেত্রে মুঠোফোন উল্লেখযোগ্যভাবে ভূমিকা রেখেছে।
বাংলাদেশিদের ৮২ শতাংশ বলেছেন যে তাঁদের নিয়োগকর্তারা মুঠোফোনে কাজের জন্য জেনারেটিভ এআই ব্যবহারকে সমর্থন করে। বাংলাদেশে মুঠোফোন ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার কারণগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি হচ্ছে কাজ, শিক্ষা।
টেলিনরের জরিপে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও ফিলিপাইনে মুঠোফোনের ব্যবহার মানুষের কর্মক্ষমতা ও কাজের মান বাড়িয়েছে। বাংলাদেশে ৯৩ শতাংশ মানুষ এটা মনে করেন। আর জীবনযাপনকে আরও স্থায়িত্ব দিয়েছে মনে করেন দেশের ৬৮ শতাংশ মানুষ।
এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে ৩৪ শতাংশ মানুষ ফাইভ–জি (পঞ্চম প্রজন্মের প্রযুক্তি) ব্যবহার করেন। যা ২০৩০ সালের মধ্যে ৪১ শতাংশে পৌঁছাবে। দক্ষিণ এশিয়ার ফাইভ–জি সংযোগের পরীক্ষামূলক কার্যক্রমে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান প্রাথমিক পর্যায়ে আছে।
টেলিনর বলছে, মুঠোফোন ব্যবহারের মাধ্যমে অনলাইনে নতুন কোনো দক্ষতা শেখার ক্ষেত্রে কাজে দিয়েছে। বাংলাদেশের ৬৬ শতাংশ মানুষ আশা করেন, অনলাইনে শেখা নতুন কোনো দক্ষতা কাজের ক্ষেত্রে তাঁদের এগিয়ে নেবে বা নতুন কোনো কাজের সুযোগ তৈরি করবে।
মানুষ জলবায়ু সম্পর্কে যে আরও সচেতন হয়ে উঠছেন, তা টেলিনরের জরিপে উঠে এসেছে। তাতে বলা হয়েছে, যারা কার্বন কম নিঃসরণ করবে, তাদের জন্য গ্রাহকেরা বেশি খরচ করতে রাজি আছেন। তরুণেরা এ ব্যাপারে বেশি সচেতন।
মুঠোফোন ব্যবহারের সুবিধা বেশি পাচ্ছেন তরুণেরা। ভাষাশিক্ষা ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে দক্ষতা বাড়িয়েছে এবং কনটেন্ট ক্রিয়েটর (আধেয় নির্মাতা) হতে সাহায্য করেছে।