সেখানে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা, পরিকল্পিত পানি ব্যবস্থাপনা ও বসতির প্রমাণ পেয়েছেন এক দল প্রত্নতাত্ত্বিক।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুরে দুই থেকে আড়াই হাজার বছরের পুরোনো একটি বাণিজ্যকেন্দ্র ও বসতি এলাকা আবিষ্কৃত হয়েছে। হাজার বছরের পুরোনো ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা, ছাঁচে–ঢালা তাম্রমুদ্রা, উত্তরাঞ্চলীয় কালো চকচকে মসৃণ মৃৎপাত্র, স্বল্প মূল্যবান পাথরের পুঁতি, ধাতব নিদর্শন, মাটি ও পাথরের মূর্তি, নানা আকৃতির পাথরের বাটখারাসহ প্রাচীন নানা প্রত্ননিদর্শন পাওয়া গেছে। এই প্রত্নাঞ্চলে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা, পরিকল্পিত পানি ব্যবস্থাপনা ও বসতির প্রমাণ পেয়েছেন এক দল প্রত্নতাত্ত্বিক।
মহাস্থানগড় ও উয়ারী-বটেশ্বরের সমসাময়িক কালের একটি প্রাচীন বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে ওই এলাকা গড়ে উঠেছিল বলে গবেষক দল মনে করছে। স্থানীয় একজন শৌখিন প্রত্ন-সংগ্রাহক ও গবেষকের সংগ্রহ করা প্রত্নসামগ্রীর সূত্র ধরে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের এক দল শিক্ষক ওই গবেষণা করেছেন। বিভাগটির সভাপতি ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডিন মোহাম্মদ সোহরাব উদ্দিন, একই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ মাহমুদুল হাছান খান, মোহাম্মদ নিয়ামুল হুদা, শারমিন রেজোয়ানা, মুতাছিম বিল্লাহ এবং শান্ত–মরিয়ম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ফারহানা নাজনীন গবেষণাটির নেতৃত্ব দিয়েছেন। আজ শনিবার রাজধানীর এশিয়াটিক সোসাইটি মিলনায়তনে আনুষ্ঠানিকভাবে ওই গবেষণার ফলাফল তুলে ধরবেন তাঁরা।
ওই এলাকার কিছু পুঁতির ছবি আমি দেখেছি, যা উয়ারী-বটেশ্বরের পুঁতির সঙ্গে মিল আছে। তবে সেখানে পরিকল্পিতভাবে খনন হওয়া দরকার।জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মুস্তাফিজুর রহমান
এ ব্যাপারে গবেষণা দলের প্রধান মোহাম্মদ সোহরাব উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘রহনপুরের ওই এলাকায় দুই থেকে আড়াই হাজার বছর আগে আদি-ঐতিহাসিক কালপর্বে অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব সময়ে বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল বলে আমরা বেশ কিছু প্রমাণ পেয়েছি। সেখানে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা এবং জলাভূমি ও পানি ব্যবস্থাপনার বেশ উন্নত প্রযুক্তি তারা গড়ে তুলেছিল। ওই এলাকায় পরিকল্পিত খনন চালালে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পাওয়া যাবে বলে আমরা মনে করছি।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মুস্তাফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই এলাকার কিছু পুঁতির ছবি আমি দেখেছি, যা উয়ারী-বটেশ্বরের পুঁতির সঙ্গে মিল আছে। তবে সেখানে পরিকল্পিতভাবে খনন হওয়া দরকার।’
গবেষকেরা বলছেন, প্রাচীন সময়ে রহনপুর ছিল উঁচু বরেন্দ্র এলাকার প্রবেশপথ। রহনপুর অঞ্চলটি পুনর্ভবা ও মহানন্দা নদীর মাঝখানে এবং গঙ্গা ও পদ্মা নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত হওয়ায় বাংলা অঞ্চলে প্রথম দিককার বসতি এলাকার মধ্যে এই অঞ্চল ছিল অন্যতম। নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর, সাপাহার ও পোরশা উপজেলা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল ও গোমস্তাপুর, রাজশাহীর তানোর ও গোদাগাড়ী এলাকায় একই সময় বসতি গড়ে উঠেছিল। বসতির পাশাপাশি সেখানে পানি সংরক্ষণাগার ও খাল তৈরির প্রমাণ পেয়েছেন গবেষকেরা। বরেন্দ্রভূমি হিসেবে চিহ্নিত ওই এলাকার একাংশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গ অংশে পড়েছে। পুণ্ড্র রাজ্য ছিল রাজশাহী, রংপুর, বগুড়া, দিনাজপুর, পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম দিনাজপুর এলাকা নিয়ে বিস্তৃত। ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক ও ইতিহাসবিদ কানিংহামের মতে, ওই এলাকায় প্রাচীন স্থায়ী বসতির নিদর্শন ছিল।
বরেন্দ্র এলাকার পূর্ব দিকে প্রাচীন পুণ্ড্রনগর বা মহাস্থানের অবস্থান। রহনপুরের সঙ্গে মহাস্থানগড়ের জলযোগাযোগ ছিল। গবেষণায় দেখা গেছে, একসময় পদ্মা নদী বর্তমান মহানন্দা ও তিস্তা হয়ে বয়ে যেত। বরেন্দ্র ভূমি আরও উঁচু হয়ে যাওয়ায় পদ্মা সেখান থেকে সরে যায়। পূর্ব ও মধ্য ভারতের সঙ্গে যোগাযোগের কেন্দ্রস্থল হিসেবে বর্তমান রহনপুর ব্যবহৃত হতো বাণিজ্য ও প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে। উত্তরাঞ্চলের প্রবেশপথ হিসেবে ওই এলাকাটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ।
রহনপুরের ওই এলাকায় দুই থেকে আড়াই হাজার বছর আগে আদি-ঐতিহাসিক কালপর্বে অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব সময়ে বাণিজ্যকেন্দ্র ছিল বলে আমরা বেশ কিছু প্রমাণ পেয়েছি। সেখানে কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা এবং জলাভূমি ও পানি ব্যবস্থাপনার বেশ উন্নত প্রযুক্তি তারা গড়ে তুলেছিল। ওই এলাকায় পরিকল্পিত খনন চালালে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পাওয়া যাবে বলে আমরা মনে করছি।গবেষণা দলের প্রধান মোহাম্মদ সোহরাব উদ্দিন
গবেষক দলটি দেড় বছর ধরে ওই এলাকায় কাজ করে স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো পরীক্ষা–নিরীক্ষা করেছে। এসব সামগ্রী ওই এলাকায় প্রক্রিয়াজাত ও তৈরি করা হতো বলে তারা প্রমাণ পেয়েছে। রহনপুর থেকে পাওয়া গেছে ব্রাহ্মী খোদিত পোড়ামাটির সিল ও সিলিং, যা প্রশাসনিক কাজে এগুলোর ব্যবহারকে নির্দেশ করে। ভারতের নালন্দা, বাংলাদেশের মহাস্থানগড়সহ বিভিন্ন স্থানে খ্রিষ্টপূর্ব সময় থেকে প্রচলিত এসব মৃৎপাত্র ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
এসব উপাদান ওই এলাকায় বাণিজ্য ও শিল্প এলাকাসহ স্থায়ী বসতির অবস্থানকে প্রমাণ করে। সেখানে একটি শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামো ছিল বলেও গবেষক দলটি মনে করছে। এসব প্রত্নসামগ্রীর বেশির ভাগ পাওয়া গেছে সংগ্রাহক মাহির ইয়াসিরের সংগ্রহশালায়। এর বাইরে গবেষক দলটি ওই এলাকায় মাঠ জরিপ করে একই ধরনের প্রত্নসামগ্রী পেয়েছে। সেখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামগ্রী হিসেবে ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা, কপারের তৈরি মুদ্রা, স্বল্প মূল্যবান পাথরের পুঁতি পাওয়া গেছে। এসব প্রত্নসামগ্রী তৈরির নানা যন্ত্র সেখানে পাওয়া গেছে।
এ ছাড়া ব্রোঞ্জের বালা, মৃৎপাত্র, টেরাকোটার তৈরি নারী ও পুরুষের মূর্তি, প্রাণীমূর্তি পাওয়া গেছে সেখানে। ছাপাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা বাংলাদেশ ও ভারতের প্রাচীন প্রত্নস্থলগুলোতে খুব কম পাওয়া যায়। এসব মুদ্রা খ্রিষ্টপূর্ব ষষ্ঠ থেকে চতুর্থ শতকে ব্যবহৃত হতো বলে অন্যান্য গবেষণায় তথ্য পাওয়া গেছে। এ ধরনের মুদ্রা এর আগে উয়ারী-বটেশ্বর, নওগাঁর ফেটগ্রাম, টেক্কাথা, বগুড়ার মহাস্থানগড়, রাজশাহীর বৈগাছা, গাইবান্ধার সাহেবগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের পোরশা এলাকায় পাওয়া গেছে। সম্রাট অশোকের আমলে এর প্রচলন শুরু হয় বলে ধারণা করা হয়। তামার তৈরি মুদ্রা দ্বিতীয় খ্রিষ্টাব্দে ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
উত্তরাঞ্চলীয় কালো মৃৎপাত্র ভারত এবং বাংলাদেশের প্রাচীন বসতির অন্যতম প্রমাণ হিসেবে মনে করা হয়। ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে এর প্রসার বেশি হয়। মহাস্থানগড় ও উয়ারী-বটেশ্বরে একই ধরনের কালো মৃৎপাত্রের ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও এ ধরনের পাত্র ব্যবহৃত হতো। তবে রহনপুরে কালো মৃৎপাত্রের পাশাপাশি সোনালি রং করা পাত্রও পাওয়া গেছে। এই অঞ্চল থেকে ৭০টি পাথরের তৈরি মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি অসম্পূর্ণ অবস্থায় আছে।
মুদ্রা এর আগে উয়ারী-বটেশ্বর, নওগাঁর ফেটগ্রাম, টেক্কাথা, বগুড়ার মহাস্থানগড়, রাজশাহীর বৈগাছা, গাইবান্ধার সাহেবগঞ্জ, চাঁপাইনবাবগঞ্জের পোরশা এলাকায় পাওয়া গেছে। সম্রাট অশোকের আমলে এর প্রচলন শুরু হয় বলে ধারণা করা হয়। তামার তৈরি মুদ্রা দ্বিতীয় খ্রিষ্টাব্দে ব্যবহারের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক এবং গবেষক মো. মোশাররফ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, রহনপুরের ওই এলাকা গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক এলাকা। স্থানীয় একজন শিক্ষক সেখানে সম্প্রতি বেলে লাল পাথরের একটি মূর্তি খুঁজে পেয়েছেন, যা খ্রিষ্টপূর্ব সময়ের। ফলে নির্দ্বিধায় বলা যায়, ওই এলাকা দুই থেকে আড়াই হাজার বছরের পুরোনো। তবে সেখানকার অন্য নিদর্শনগুলো যাতে নষ্ট ও হারিয়ে না যায়, সে জন্য তা দ্রুত খনন করতে হবে। স্থান ও নিদর্শনগুলো সংরক্ষণ করতে হবে।