প্রথম আলোকে হয়রানি বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সংকট গভীর হওয়ার ইঙ্গিত

যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ দৈনিক সংবাদপত্র প্রথম আলো আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। দেশটিতে গণমাধ্যমের ওপর বাড়তে থাকা আক্রমণের সর্বশেষ ঘটনা এটি। সেখানে গণমাধ্যমকে ভয় দেখানো, হয়রানি ও সাংবাদিকদের গ্রেপ্তারের মতো বিষয়গুলো রয়েছে। প্রথম আলোর ওপর এই আক্রমণ বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সংকট গভীর হওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে। আজ বুধবার অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ওয়েবসাইটে এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়েছে।

অ্যামনেস্টি বলেছে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সোমবার জাতীয় সংসদে ভাষণে প্রথম আলোকে ‘আওয়ামী লীগের শত্রু, গণতন্ত্রের শত্রু এবং দেশের মানুষের শত্রু’ বলেছেন। তিনি এ কথা বলেছেন স্বাধীনতা দিবসে জীবনযাত্রার ব্যয় নিয়ে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের সূত্র ধরে। ওই প্রতিবেদনের প্রতিবেদক শামসুজ্জামানকে আটক করে তাঁর বিরুদ্ধে দেশের কঠোরতম আইন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে (ডিএসএ) মামলা দেওয়া হয়। পরে তিনি জামিনে মুক্ত হন। প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দেওয়া হয়েছে। শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে যে দুটি মামলা হয়েছে, তার একটিতে প্রথম আলো সম্পাদককে প্রধান আসামি করা হয়েছে।  

জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের কয়েক ঘণ্টা পর একদল ব্যক্তি রাজধানী ঢাকায় প্রথম আলোর কার্যালয়ে জোর করে ঢুকে পড়েন। তাঁরা হুমকি দেওয়ার পাশাপাশি প্রথম আলোর লোগোর ওপরে ‘বর্জন কর’ (বয়কট) লিখে দেন।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক আঞ্চলিক পরিচালক ইয়ামিনি মিশ্র বলেছেন, ‘বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার জন্য হুমকিস্বরূপ সরকার ধারাবাহিকভাবে যেসব আক্রমণ চালিয়ে আসছে, তার সর্বশেষ ঘটনা এটি। সরকার বা সরকারি নীতির সমালোচনার জন্য সংবাদমাধ্যম, সংবাদপ্রকাশক বা সাংবাদিককে শাস্তি দেওয়াটা মতপ্রকাশের অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করে, যা কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।’

দেশের সর্বাধিক প্রচারিত দৈনিক প্রথম আলোর ওপর এই আক্রমণ এসেছে গত মাসে প্রধান বিরোধী দলের একমাত্র মুখপত্র দৈনিক দিনকাল বন্ধের রেশ কাটতে না কাটতে।’

তিনি বলেন, সাংবাদিকদের ওপর কঠোরতম ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার এবং দেশের সর্ববৃহৎ সংবাদপ্রকাশকদের ওপর আক্রমণ—দুটি বিষয় মিলিয়ে বাংলাদেশে দমনপীড়ন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার দমিয়ে রাখার উদ্বেগজনক প্রবণতার ইঙ্গিত দিচ্ছে।

‘দুশ্চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম’

গত ২৯ মার্চ ভোররাতে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরিচয়ে সাদাপোশাকের একদল লোক বাংলাদেশি সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে তাঁর বাসা থেকে তুলে নিয়ে আসে। এরপর প্রায় ১০ ঘণ্টা (বস্তুত ২০ ঘণ্টা) তিনি কোথায় ছিলেন, তা জানা যাচ্ছিল না। পরে পুলিশ জানায়, তাঁকে আটক করা হয়েছে এবং তাঁর বিরুদ্ধে দেশের কঠোরতম আইন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে।

শামসুজ্জামানের পরিবারের একজন সদস্য অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে বলেছেন, ‘আমরা চিন্তায় চিন্তায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। তাঁর বিরুদ্ধে কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল না। কেউ আমাদের কিছু বলেনি। এমনকি যখন তাঁকে আটকের বিষয়ে নিশ্চিত করা হয়, তা-ও আমরা জেনেছিলাম গণমাধ্যম সূত্রে।’

প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান এবং একজন আলোকচিত্রীসহ ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ একদল ব্যক্তিকেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় আসামি করা হয়েছে। ৩ এপ্রিল জামিন পেয়ে শামসুজ্জামান কারাগার থেকে মুক্ত হলেও মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁর সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।

‘সন্ত্রাসের পরিবেশ’

বাংলাদেশ থেকে একজন জ্যেষ্ঠ বার্তা সম্পাদক অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে প্রথম আলোর ওপর সরকারের আক্রমণকে ‘জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে সন্ত্রাসের পরিবেশ তৈরির’ একটি বেপরোয়া চেষ্টা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেছেন, ‘সরকার খুব স্পষ্ট একটি বার্তা দিচ্ছে, আমরা যে ভাষ্য দিচ্ছি সেটার বাইরে গেলে এমনটাই ঘটবে। সাংবাদিকেরা জামিন পেলেও মামলা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তাঁদের ওপর চাপ থাকবে। যাঁরা বাংলাদেশে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর চলমান আক্রমণের সমালোচনা করছেন, তাঁদের অনেকে মনে করেন, সাংবাদিকদের লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার করা হচ্ছে। এটা একটি ভুল ধারণা। এই আইনের অপব্যবহার হচ্ছে না, এটা সেভাবেই ব্যবহার করা হচ্ছে যেমনটা সরকার চেয়েছে।’

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ গত ২০ ফেব্রুয়ারি দৈনিক দিনকালের প্রকাশনা বন্ধ করে, যেটা ছিল প্রধান বিরোধী দল বিএনপির একমাত্র সংবাদপত্র। বাংলাদেশি মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে দেশে মোট ৫৬ জন সাংবাদিককে নির্যাতন, হয়রানি, মামলার আসামি করা, ভয় দেখানো এবং পেশাগত কাজে বাধা দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে।

এর আগে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ে সংবাদপ্রকাশের জন্য স্বাধীন সংবাদমাধ্যম ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা বৃদ্ধির তথ্য সংগ্রহ করেছিল। ভিন্নমত প্রকাশের জন্য সাংবাদিক, প্রতিবাদকারী ও মানবাধিকারকর্মীদের দমনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫ ধারা (ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ডিজিটাল মাধ্যমে মিথ্যা বা আক্রমণাত্মক তথ্য প্রকাশ), ২৯ ধারা (মানহানিকর তথ্য প্রকাশ বা প্রচার), ৩১ ধারাকে (আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর মতো কিছু প্রকাশ) কীভাবে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, তা প্রকাশ করা হয়েছিল।

গত ৩১ মার্চ জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক বাংলাদেশ সরকারের প্রতি অবিলম্বে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগ স্থগিতের আহ্বান জানান। আইনটি সংশোধন করে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ করার আহ্বান জানান তিনি। বাংলাদেশজুড়ে সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের গ্রেপ্তার, হয়রানি ও ভয় দেখাতে এবং অনলাইনে ভিন্নমতের কণ্ঠরোধ করতে এই আইন ব্যবহার করা হচ্ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেন তিনি।

অ্যামনেস্টির দক্ষিণ এশিয়া পরিচালক ইয়ামিনি মিশ্র বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন শুরু থেকেই ভিন্নমত দমনে বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের একটি হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এই আইনের কয়েকটি ধারা অস্পষ্ট এবং বিস্তৃত পরিসরে সেগুলো প্রয়োগের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষ স্বাধীন সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণে তার সদ্ব্যবহার করছে। কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল এবং অবিলম্বে সাংবাদিকদের হয়রানি ও ভীতি প্রদর্শন বন্ধ করতে হবে।