৫ আগস্টের পর থেকে ঢাকা লাইভের ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজ বন্ধ। কার্যালয় তালাবদ্ধ।
আইসিটি বিভাগের ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল বন্ধ। পাসওয়ার্ড জানেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী।
সাবেক তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদ পলকের অনুষ্ঠানের লাইভ সম্প্রচারের একচেটিয়া কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠান ঢাকা লাইভ ‘উধাও’ হয়ে গেছে। তাদের ওয়েবসাইট ও ফেসবুক পেজ হঠাৎ ‘গায়েব’ হয়ে গেছে। প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ও তালাবদ্ধ।
আইসিটি বিভাগের বিভিন্ন অনুষ্ঠান, জুনাইদ আহ্মেদের অংশ নেওয়া আলোচনা সভা ও বৈঠকের সরাসরি সম্প্রচার করত ঢাকা লাইভ। আইসিটি বিভাগের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরাসরি সম্প্রচারের ক্ষেত্রে কাজ দেওয়ার জন্য কোনো দরপত্র আহ্বানের কথা তাঁরা জানেন না। ঢাকা লাইভকে কাজ দেওয়া হতো সাবেক প্রতিমন্ত্রীর ইচ্ছায়। টাকার পরিমাণও ঠিক করে দিতেন তিনি।
সাবেক আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদের অনুষ্ঠানের সরাসরি সম্প্রচারকাজ একচেটিয়াভাবে পেত ঢাকা লাইভ।
ঢাকা লাইভ কতটি অনুষ্ঠান সম্প্রচার করেছে, কত টাকা তাদের দেওয়া হয়েছে, এ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে ২০২২ সালে বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের একটি আলোচনা সভা ১ ঘণ্টা ৪৪ মিনিট ফেসবুকে সম্প্রচারের জন্য বরাদ্দ ছিল ২ লাখ টাকা। সম্প্রচারটি করেছিল ঢাকা লাইভ।
আইসিটি বিভাগের সচিব মো. সামসুল আরেফিন গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিষয়গুলো সাবেক প্রতিমন্ত্রী নিজে দেখতেন। ঢাকা লাইভকে টাকা দেওয়ার বিষয়গুলো তাঁর জানা নেই।
ইজি টেকনোলজি লিমিটেড নামের একটি প্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানের সহযোগী ঢাকা লাইভ। ইজি টেকনোলজি ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। অন্যদিকে ২০১৬ সালের দিকে ঢাকা লাইভ কার্যক্রম শুরু করে। গত মার্চে ঢাকা লাইভ প্রথম আলোর কাছে দাবি করেছিল, উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে তারা ট্রেড লাইসেন্স নিয়েছে। তবে উত্তর সিটিতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এ নামে কোনো প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স নেয়নি।
আইসিটি বিভাগের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রচার, প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কাজ পেত ইজি টেকনোলজি। সর্বশেষ গত মার্চে ‘মোবাইল গেম ও অ্যাপ্লিকেশনের দক্ষতা উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের দেড় কোটি টাকার একটি কাজ পায় তারা।
ইজি টেকনোলজির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মফিজুর রহমান। তাঁর মুঠোফোন নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। হোয়াটসঅ্যাপে কল করা ও খুদে বার্তা পাঠানো হলেও তিনি সাড়া দেননি। অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কর্মরত শাহাব উদ্দিন নামের এক ব্যক্তি দাবি করেন, তিনি ও মফিজুর ২০১৫ সালে ঢাকা লাইভ চালু করেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁকে সহপ্রতিষ্ঠাতা হিসেবেও পরিচয় করিয়ে দেওয়া হতো। তবে যৌথ মালিকানার নথিপত্র তৈরি না করে তিনি ভুল করেছিলেন। ২০১৭ সালের দিকে মফিজুর ঢাকা লাইভের নিয়ন্ত্রণ পুরো নিয়ে নেন।
আইসিটি বিভাগের ভেরিফায়েড (স্বীকৃত) ফেসবুক পেজ গত মার্চে ঘেঁটে দেখা যায়, বিভাগটি থেকে ২০১৬ সালের ২ অক্টোবর প্রথম কোনো অনুষ্ঠান সরাসরি সম্প্রচার করা হয়। কাজটি করেছিল ঢাকা লাইভ। এরপর তারা নিয়মিত কাজ পেয়েছে।
প্রথম আলো ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছরের ২৬ মার্চ পর্যন্ত অন্তত ৬৭টি অনুষ্ঠান ঢাকা লাইভের মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করার তথ্য পায়। প্রতিটি অনুষ্ঠানে গড়ে দেড় লাখ টাকা করে দেওয়া হলে ওই সময়ে ঢাকা লাইভ আয় করেছে এক কোটি টাকার মতো।
আইসিটি বিভাগ সূত্র জানায়, সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদের সঙ্গে ঢাকা লাইভের মালিক মফিজুরের সখ্য ছিল। সেটা আইসিটি বিভাগের সবাই জানেন। ঢাকা লাইভ যেহেতু কোনো নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠান নয়, সেহেতু এই প্রতিষ্ঠানের মালিকানার সঙ্গে সাবেক প্রতিমন্ত্রীর স্বজনদের কারও সংশ্লিষ্টতা ছিল কি না, তা জানাতে পারেননি কেউ।
ঢাকা লাইভের মূল প্রতিষ্ঠান ইজি টেকনোলজির কার্যালয় ঢাকার কারওয়ান বাজারে। গত রোববার গিয়ে দেখা যায়, কার্যালয়টি তালাবদ্ধ। একটি সূত্র বলছে, বনানীতে প্রতিষ্ঠানটির একটি কার্যালয় আছে। সেটিও তালাবদ্ধ। তবে কার্যালয়ের ঠিকানা পাওয়া যায়নি।
ঢাকা লাইভের চিফ অপারেটিং অফিসার (সিওও) আরিফুল হক চৌধুরী গত সোমবার মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের কার্যালয় চালু রয়েছে। ঠিকানা চাইলে বলেন, তিনি কয়েক মাস আগেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন।
আইসিটি বিভাগের ফেসবুক পেজ নিষ্ক্রিয়
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। পরদিন ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সাবেক প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহ্মেদকে আটক করা হয়। ১৪ আগস্ট একটি হত্যা মামলায় তাঁকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
এর পর থেকে আইসিটি বিভাগের ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল বন্ধ রয়েছে। আইসিটি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেলের নিয়ন্ত্রণ ছিল জুনাইদ আহ্মেদের কাছে। পরিচালনা করত ঢাকা লাইভ। তারাই পাসওয়ার্ড জানে, তা উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, আইসিটি বিভাগের ফেসবুক পেজ ও ইউটিউব চ্যানেল কোনো ব্যক্তির সম্পদ নয়, এটি সরকারের সম্পদ। এটির নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা সরকারি বিধি মেনে হওয়া উচিত। কোনো ব্যক্তির পরিবর্তনে পেজ ও চ্যানেল হাতছাড়া হবে, সেটা গ্রহণযোগ্য নয়।
বিষয়টি নিয়ে আইসিটি বিভাগের দায়িত্বে থাকা অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, আইসিটি বিভাগের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়ের কাছে ছিল না। সাবেক প্রতিমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে পরিচালনা করতেন। তিনি চলে যাওয়ার সময় পেজগুলো বন্ধ করে দিয়েছিলেন। পুনরায় চালুর জন্য মন্ত্রণালয় থেকে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
নাহিদ আরও বলেন, ‘যতুটুকু জেনেছি, পেজ নিয়ন্ত্রণে নেওয়া হয়েছে। দ্রুতই পেজ থেকে কার্যক্রম শুরু করা হবে।’