আন্তর্জাতিক গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত আলোচনা সভায় বাঁ থেকে মফিদুল হক, ওফেলিয়া লিয়ঁ, আসাদুজ্জামান নূর
আন্তর্জাতিক গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত আলোচনা সভায় বাঁ থেকে মফিদুল হক, ওফেলিয়া লিয়ঁ, আসাদুজ্জামান নূর

আন্তর্জাতিক গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবসের আলোচনা

পাকিস্তানের উচিত ক্ষমা চাওয়া: ওফেলিয়া লিয়ঁ

১৯৭১ সালে পাকিস্তান যে ভুল করেছে, তার জন্য অহংবোধ সরিয়ে রেখে দেশটির উচিত বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়া। একই ধর্মের হয়েও তারা ওই সময়ের পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ওপর নির্যাতন করেছে। নিজেদের উর্দু ভাষা রাষ্ট্রীয় ভাষা হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছে।

৯ ডিসেম্বর শুক্রবার আন্তর্জাতিক গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে এ কথা বলেন গণ অপরাধের শিকার ভুক্তভোগীদের স্মরণে আন্তর্জাতিক কমিটি  ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব মেমোরিয়াল মিউজিয়ামস ইন রিমেমব্রেন্স অব দ্য ভিকটিমস অব পাবলিক ক্রাইমসের (আইসিমেমো) সাবেক চেয়ারপারসন ওফেলিয়া লিয়ঁ।

২০১৫ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ৯ ডিসেম্বর দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা স্মরণ ও প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। এর পর থেকে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিবছর দিনটি পালন করে আসছে। শুক্রবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে বিশেষ আলোচনা সভা ও নাট্য প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। দিবসটি উপলক্ষে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সাত দিনব্যাপী নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন রেখেছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর।

এ বছর দিবসটি পালন উপলক্ষে অতিথি বক্তা হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয় আইসিমেমোর সাবেক চেয়ারপারসন ওফেলিয়া লিয়ঁ। আইসিমেমো হলো আন্তর্জাতিক জাদুঘর কাউন্সিলের (আইকম) একটি আন্তর্জাতিক কমিটি। ২০০১ সালের ৩ জুলাই আইকমের সাধারণ সম্মেলনে স্পেনের বার্সেলোনায় এ কমিটি গঠিত হয়।

আলোচনা সভায় ওফেলিয়া লিয়ঁ বলেন, ভাষা যেকোনো দেশের জন্য আত্মপরিচয়। সেই ভাষার ওপর আঘাত হেনেছিল পাকিস্তান। ১৯৭১ সালে গণহত্যা সংঘটিত করেছিল।

বক্তব্যে শেষে ওফেলিয়া লিয়ঁ এক প্রশ্নের জবাবে পাকিস্তান প্রসঙ্গে বলেন, কাউকে ক্ষমা চাইতে বলার বিষয়ে জোর করা যায় না। পাকিস্তানের উচিত অহংবোধ সরিয়ে রেখে বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়া।

বাংলাদেশের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রসঙ্গে ওফেলিয়া লিয়ঁ বলেন, তুরস্কের অটোমানদের হাতে লাখ লাখ আর্মেনীয় হত্যার শিকার হয়েছিল। ১০০ বছর পর সে গণহত্যার স্বীকৃতি এসেছে। বাংলাদেশের গণহত্যারও একদিন আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আসবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।

দেশে দেশে গণহত্যা ও নারী ধর্ষণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে ওফেলিয়া লিয়ঁ বলেন, সবার এখন একসঙ্গে এ হত্যা বন্ধে সোচ্চার হওয়া উচিত। পশুর মতো আচরণ করা বন্ধ হওয়া উচিত। গণহত্যার বিরুদ্ধে, মানবতার বিরুদ্ধে, অপরাধের বিরুদ্ধে চলার পথটি সহজ নয়। এরপরও এ পথ ধরে এগোতে হবে, যাঁরা আত্মত্যাগ করেছেন তাঁদের কথা স্মরণ করে। এসব অপরাধের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে স্মৃতি সংরক্ষণ করতে হবে।

সভায় সূচনা বক্তব্যে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ও সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর উপস্থিত তরুণ প্রজন্মের উদ্দেশে বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমরা গণহত্যা প্রত্যক্ষ করেছি। ভারতে পাঠানোর কথা বলে সৈয়দপুরে সাড়ে ৩০০ মানুষকে একটি ট্রেনে তুলে দেওয়া হয়েছিল। শহরের বাইরে ট্রেন থেকে সেই লোকজনকে নামিয়ে গলা কেটে হত্যা করা হয়।’ তিনি তাঁর দুই বন্ধুর কথা উল্লেখ করেন, যাঁদের একজন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় নিখোঁজ হয়েছিলেন। আরেক বন্ধুকে গলায় দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে পরে গলা কেটে হত্যা করা হয়।

আসাদুজ্জামান নূর বলেন, এ ধরনের বীভৎস হত্যাকাণ্ড গণতন্ত্রের জন্য চ্যালেঞ্জ। এখনো বিভিন্ন দেশে রাজনীতি, ধর্ম এমনকি গণতন্ত্রের নামে গণহত্যা হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়াজ তুলতে হবে। একাত্তরের্র গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেতে গণহত্যার সময়ের কথা আরও প্রবলভাবে ছড়িয়ে দিতে হবে। একাত্তরের গণহত্যা স্বীকৃতি পেলে শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে।

অনুষ্ঠানে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ ও নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরে মফিদুল হক বলেন, যেসব দেশে নৃশংসতা ও নির্মম হত্যাকাণ্ড হয়েছে, সেখানে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে স্মৃতি সংরক্ষণ করা। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মুক্তিযুদ্ধের দায় মোচনের চেষ্টা করছে। এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি বিষয় হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ। আরেকটি বড় দায় হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের তথ্য তুলে ধরে নতুন প্রজন্মকে শিক্ষিত করে তোলা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। তবে ১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মাধ্যমে ট্রাইব্যুনালের কাজ বাধাগ্রস্ত হয়। এর পর থেকে ইতিহাস বিকৃত করা ও বিস্মৃতি ঘটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। তিনি একাত্তরের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায় করার জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন।

আলোচনা সভায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম কবি শামসুর রাহমানের কবিতা ‘অভিশাপ দিচ্ছি’ আবৃত্তি করেন। আলোচনা সভা শেষে সেলিম আল দীন রচিত ও নাসির উদ্দীন ইউসুফ নির্দেশিত ‘নিমজ্জন’ নাটকটি পরিবেশন করে ঢাকা থিয়েটার।