‘দেশটাকে তো জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছেন’—বিচারপতির এমন মন্তব্য–সংবলিত খবর প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নজরে এনেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। পরে তিনি বলেছেন, একজন বিচারক, যিনি সংবিধান সংরক্ষণের জন্য শপথ নিয়েছেন—তাঁর এ ধরনের অসাংবিধানিক কথা বলা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক। এর মাধ্যমে ওই বিচারক তাঁর শপথ ভঙ্গ করেছেন বলে মনে করছেন তিনি।
মানবাধিকার সংস্থা অধিকারের সম্পাদক আদিলুর রহমান খান ও পরিচালক এ এস এম নাসির উদ্দিনের করা আপিলের গ্রহণযোগ্যতাবিষয়ক শুনানিতে আজ মঙ্গলবার সকালে রাষ্ট্রপক্ষের উদ্দেশে বিচারপতি মো. ইমদাদুল হক আজাদের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ ওই মন্তব্য করেন।
বিষয়টি নিয়ে দুপুরে প্রধান বিচারপতির কার্যালয়ে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। ওই মন্তব্য নিয়ে অনলাইন ও পত্রিকার সংস্করণে প্রকাশিত খবর প্রধান বিচারপতির নজরে আনেন তিনি। পরে বিকেলে নিজ কার্যালয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ‘বিষয়টি জানার পরে আমার সঙ্গে আমার কর্তৃপক্ষের আলাপ হয়েছে। পরবর্তী সময়ে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করে সংবাদের কপি তুলে দিয়ে এসেছি।’
অ্যাটর্নি জেনারেল আরও বলেন, ‘আমি অত্যন্ত ভারাক্রান্ত ও দুঃখিত কথাটি শোনার পর। একজন বিচারক এ ধরনের মন্তব্য করতে পারেন কি না। দেশটাকে জাহান্নাম করে দিয়েছেন—এ ধরনের কথা কোনো বিচারক বলতে পারেন না। উনি নিশ্চয়ই রাজনীতি করেন না। দেশের বিচার বিভাগ নিয়ে বিভিন্ন শ্রেণি-গোষ্ঠী ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে বিভিন্ন ধরনের কথা বলছে, জানি না উনার এই কথাটি কি তাদের লাভবান করার জন্য কি না—বিষয়টি খতিয়ে দেখতে হবে।’
তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের (আইসিটি) ৫৭ ধারার মামলায় গত ১৪ সেপ্টেম্বর আদিলুর ও নাসিরকে দুই বছর করে কারাদণ্ড দেন ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল। এক দশক আগের ঘটনায় ওই মামলাটি হয়। ট্রাইব্যুনালের রায়ে আদিলুর ও নাসিরকে ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক মাস করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এই জেল-জরিমানার রায়ের বিরুদ্ধে গত ২৫ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে আপিল করে জামিন চান আদিলুর ও নাসির। আজ বিষয়টি বিচারপতি মো. ইমদাদুল হক আজাদের একক হাইকোর্ট বেঞ্চে শুনানির জন্য ওঠে।
আদালতে আদিলুর ও নাসিরের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী, রুহুল আমিন ভূঁইয়া ও মো. আহসানুজ্জামান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল রেজাউল করিম।
বেলা ১১টার পর ক্রম অনুসারে বিষয়টি উঠলে আদালতকক্ষে থাকা ডায়াসের (আইনজীবী যেখানে দাঁড়িয়ে শুনানি করেন) সামনে গিয়ে দাঁড়ান জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী। তখন আদালতকক্ষে থাকা আসন (যেখানে আইন কর্মকর্তারা বসেন) থেকে দাঁড়িয়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল রেজাউল করিম বলেন, ‘আমাদেরও বক্তব্য আছে।’
তখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘তাঁদের (আপিলকারীদের) আইনজীবীদের আগে বলতে দিন। আপনি আগেই লাফ দিয়ে উঠছেন কেন?...দেশটাকে তো জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছেন।’
পরে আদিলুর ও নাসিরের আইনজীবী এ জে মোহাম্মদ আলী শুনানিতে বলেন, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইনের মামলায় (আপিলকারীদের) দুই বছর করে কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে। আদালত বলেন, ‘কী জন্য দিয়েছে?’ তখন এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘৫৭ (২) ধারায় সাজা দিয়েছে।’ আদালত বলেন, ‘জামিনের আবেদন দিয়েছেন কি?’ তখন এ জে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘জামিনের আবেদনও রয়েছে।’
এরপর শুনানিতে অংশ নিয়ে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল রেজাউল করিম বলেন, তাঁদের (আদিলুর ও নাসির) বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য দেওয়া, অপপ্রচার ও গুজব ছড়ানোর অভিযোগ রয়েছে। তখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘তাহলে তাঁদের (আদিলুর ও নাসির) কম সাজা দিলেন কেন? তাহলে তো যাবজ্জীবন সাজা দেওয়া উচিত ছিল। দুই বছর দিলেন কেন?’ পরে আদালত আদিলুর ও নাসিরের আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন। একই সঙ্গে তাঁদের জরিমানা স্থগিত ও জামিন মঞ্জুর করে আদেশ দেন। এই জামিনের ফলে আপাতত আদিলুর ও নাসিরের কারামুক্তিতে আইনগত বাধা নেই বলে জানিয়েছেন তাঁদের আইনজীবী রুহুল আমিন ভূঁইয়া।
২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান নিয়ে অসত্য-বিকৃত তথ্য প্রচারের অভিযোগে আদিলুর ও নাসিরের বিরুদ্ধে মামলাটি হয়েছিল।