চিকিৎসকেরা বলছেন, নিউমোনিয়ার পাশাপাশি অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত শিশুদের মৃত্যুর হার বেশি।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বাংলাদেশ শিশু হাসপাতালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুদের জন্য নির্ধারিত ৭১২ নম্বর ওয়ার্ডের ১৯টি শয্যার একটিও ফাঁকা নেই। এই ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন নাটোরের গুরুদাসপুরের শামীম রেজার ২ বছর ১০ মাস বয়সী মেয়ে সামিয়া খাতুন।
গতকাল বুধবার দুপুরে এই ওয়ার্ডের বাইরে শামীম অপেক্ষা করছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বললেন, তাঁর মেয়ে যক্ষ্মার পাশাপাশি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত। এক মাস আট দিন ধরে তাঁরা এই হাসপাতালে আছেন। এর মধ্যে ২১ দিন তাঁর মেয়ে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ছিল। এখন সাধারণ ওয়ার্ডে পাঠালেও মেয়ের অবস্থার খুব একটা উন্নতি হয়নি।
কর্তব্যরত চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শীত মৌসুম শুরু হওয়ায় ঠান্ডাজনিত রোগবালাই বাড়ছে। এই হাসপাতালে শয্যার বাইরে রোগী ভর্তি নেওয়া হয় না। ৭১২ নম্বর নিউমোনিয়া ওয়ার্ডের অধিকাংশ রোগীর অবস্থাই গুরুতর।
শিশু হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, নিউমোনিয়ার পাশাপাশি অন্য রোগ আছে এমন ৮৪টি শিশুর মৃত্যু হয়েছে গত ৫০ দিনে। নভেম্বরে এই হাসপাতালে মোট ১৫৪ জনের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে অন্য রোগের পাশাপাশি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত এমন শিশু মারা গেছে ৫৩টি। একইভাবে ডিসেম্বরের প্রথম ২০ দিনে এই হাসপাতালে মারা যাওয়া মোট ১১৫ শিশুর মধ্যে অন্য রোগের পাশাপাশি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত এমন শিশু মারা গেছে ৩১টি।
চিকিৎসকেরা বলছেন, শুধু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শিশুমৃত্যু খুবই কম। তবে নিউমোনিয়ার পাশাপাশি অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত শিশুর মৃত্যু বেশি।
শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক ফারহানা আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, তীব্র সংক্রমণ নিয়ে আসা, দেরি করে আসা এবং দুর্বল শিশুরা বেশি মারা যাচ্ছে। নিউমোনিয়া সংক্রমণ এড়াতে ঠান্ডা পানি, মাটি ও বাতাস থেকে শিশুদের দূরে রাখার পরামর্শ দেন তিনি।
গত বছরের তুলনায় এবার নিউমোনিয়ার সংক্রমণ বেড়েছে। ২০২২ সালে ৩ হাজার ১০৩টি শিশু নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। এবার ১১ দিন বাকি থাকতেই ৩ হাজার ৩৫৩টি শিশুটি নিউমোনিয়া নিয়ে এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
হাসপাতালের তথ্য বলছে, চলতি মৌসুমে একটু আগেভাগেই নিউমোনিয়ার সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। গত বছর অক্টোবর থেকে নিউমোনিয়ায় সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছিল। এবার সেপ্টেম্বর মাস থেকে নিউমোনিয়া রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে ৩০২ জন, অক্টোবরে ৩৪৫ জন, নভেম্বরে ৩৮৮ জন এবং ডিসেম্বরের প্রথম ২০ দিনে ২৬৭টি শিশু নিউমোনিয়া নিয়ে এই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বরের প্রথম ২০ দিনে বহির্বিভাগে মোট ৭৩৫টি শিশু নিউমোনিয়া–সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে এসেছে। গত ২৪ ঘণ্টায় নিউমোনিয়া নিয়ে ৫৬ শিশু বহির্বিভাগে আসে, ৯ শিশু ভর্তি হয়েছে। এখন নিউমোনিয়া সংক্রান্ত জটিলতা নিয়ে এই হাসপাতালে ভর্তি আছে ৯৬টি শিশু।
চিকিৎসকেরা বলছেন, নিউমোনিয়া ছাড়াও ঠান্ডায় ব্রঙ্কিওলাইটিস, অ্যাজমা, ডায়রিয়া ও ত্বকে সংক্রমণ বেড়ে যায়। শিশু হাসপাতালে এ ধরনের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। তবে নিউমোনিয়া ছাড়া বাকি রোগগুলোর তথ্য আলাদাভাবে সংরক্ষণ করে না এই হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
চিকিৎসকদের মতে, শীতকালে ঠান্ডার পাশাপাশি বাতাসে ধুলাবালু বেড়ে যায়। যা অ্যাজমার সংক্রমণ বাড়িয়ে দেয়। ফলে শীতকালীন রোগবালাই থেকে সুরক্ষায় ঠান্ডা ও ধুলা এড়িয়ে চলতে হবে।
শিশু হাসপাতালের কাছাকাছি শেরেবাংলা নগর এলাকায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শীতজনিত জটিলতায় ভোগা রোগীদের তথ্য সংরক্ষণ করা হয় না। ফলে নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য শীতকালীন রোগে কতজন এই হাসপাতালে ভর্তি আছেন তা জানা যায়নি। তবে এই হাসপাতালের শিশু ও পুরুষ ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, উভয় ওয়ার্ডেই শয্যা ফাঁকা রয়েছে। শিশুদের পাশাপাশি বয়স্করাও শীতজনিত জটিলতা নিয়ে ভর্তি হচ্ছেন।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, এই হাসপাতালের ৩১৩ নম্বর শিশু ওয়ার্ডে ৫০টি শয্যা রয়েছে। এর মধ্যে ৩৩টি শয্যায় রোগী আছে। রোগীদের মধ্যে ১৩ শিশু নিউমোনিয়ায় এবং দুজন ব্রঙ্কিওলাইটিসে আক্রান্ত।
কর্তব্যরত চিকিৎসকেরা জানান, শীতে তুলনামূলক রোগীর চাপ কম থাকে। তবে এখন যারা ভর্তি হচ্ছে, তাদের বড় অংশই শীতজনিত জটিলতা নিয়েই ভর্তি হচ্ছে।