‘নাগরিক সমাজ: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক জাতীয় মতবিনিময় সভা। লেক শোর হোটেল, গুলশান–২, ঢাকা
‘নাগরিক সমাজ: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক জাতীয় মতবিনিময় সভা। লেক শোর হোটেল, গুলশান–২, ঢাকা

নতুন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নের পথ মোটেই মসৃণ নয়

‘নাগরিক সমাজ: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক জাতীয় মতবিনিময় সভা। বক্তারা বলেছেন, নতুন প্রেক্ষাপটে আশার পাশাপাশি শঙ্কাও রয়েছে।

ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ শুধু বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গড়া নয়, সার্বিকভাবেই রাষ্ট্র পুনর্গঠনের একটি সুযোগ করে দিয়েছে। নতুন প্রেক্ষাপটে সবাই আশাবাদী হতে চান; কিন্তু এখানে শঙ্কারও কারণ আছে। অন্তর্বর্তী সরকারের বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং নতুন রাষ্ট্র গঠনে স্বপ্নের পথ মোটেই মসৃণ নয়।

আজ শনিবার ‘নাগরিক সমাজ: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ’ শীর্ষক জাতীয় মতবিনিময় সভায় বক্তারা এ কথাগুলো বলেছেন। বাংলাদেশে কর্মরত তিন শতাধিক বেসরকারি সংস্থা, নাগরিক সংগঠন ও প্ল্যাটফর্ম, নারী আন্দোলন, মানবাধিকার সংগঠন, সামাজিক উদ্যোক্তা এবং গবেষকদের ঐক্যজোট ‘সিএসও অ্যালায়েন্স’ রাজধানীর একটি হোটেলে ওই মতবিনিময় সভার আয়োজন করে।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের চেয়ারপারসন হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ পরিবর্তনের একটি সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। শুধু বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গঠন নয়, সার্বিকভাবে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের সুযোগ তৈরি হয়েছে।

তবে একপেশে চিন্তার মধ্যে আটকে গেলে সমস্যা—এমন মন্তব্য করে হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, যে প্রেক্ষিত তৈরি হয়েছে, সেখানে রাজনীতিকে নেতিবাচক জগৎ হিসেবে দেখলে যে সুযোগ তৈরি হয়েছে, সেটাকে এগিয়ে নেওয়া যাবে না। রাজনীতি আর রাজনৈতিকভাবে চিন্তা করা দুটি আলাদা বিষয়। সবারই রাজনৈতিকভাবে চিন্তা করা উচিত। এটি নাগরিক সমাজের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ। তিনি বলেন, ক্ষমতার চরিত্র যদি প্লুরালেস্টিক (বহুত্ববাদী) না হয়, তাহলে অতীতে যা হয়েছে, সামনেও সেটাই হবে। তিনি দলীয় প্রতীকে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বিধান বাতিল করার দাবি জানান।

নতুন আশার পাশাপাশি শঙ্কারও কারণ দেখছেন ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান। তিনি বলেন, নতুন প্রেক্ষাপটে সবাই আশাবাদী হতে চান। কিন্তু শঙ্কার কারণও আছে। নতুন বাংলাদেশের ‘ভিশন’ নিয়ে ঐকমত্য আছে। কিন্তু আন্দোলনে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে বহুমুখী শক্তি আছে। তাঁদের অনেকের ‘এজেন্ডা’ বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মূল চেতনার পুরোপুরি বিপরীত। তাঁদের এজেন্ডা বৈষম্য সৃষ্টি করা। লিঙ্গ, ধর্ম, সংস্কৃতির ওপর নির্ভর করে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ে তোলার স্বপ্নের পরিপন্থী শক্তি আগ্রাসীভাবে কাজ করছে। এ ক্ষেত্রে নাগরিক সমাজ, এনজিও কি নীরব থাকতে পারে—এমন প্রশ্ন রেখে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, তাদের কাজ করতে হবে। আর সরকারকে সে পরিবেশ করে দিতে হবে।

যখন যারা ক্ষমতায় ছিল, তারা নাগরিক সমাজকে শত্রু ভেবেছে—এমন মন্তব্য করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, তাঁরা কাজ করেন সরকারকে সহায়তা করার জন্য; কিন্তু সরকার সেটা বোঝে না। একটি সংস্থাকে নিয়ে জাতীয় সংসদে পর্যন্ত দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের ১২২টি শাখা আছে। অন্য কোথাও অর্থছাড়ে এনজিও ব্যুরোর মতো কোনো সংস্থার অনুমোদন লাগে না।

অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান অনুষ্ঠানে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হন। তিনি বলেন, নতুন সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে কতগুলো জায়গায় অস্থিরতা হচ্ছে। ঘটনার অন্তরালে আরও অনেক ঘটনা থাকে। হঠাৎ করে দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি মারাত্মক অস্বস্তির মধ্যে পড়ে গেল। অথচ এই বাংলাদেশে নিজেকে কখনো সাম্প্রদায়িক মনে হয়নি। অনেক সময় খালি চোখে যা দেখা যায়, ঘটনার অন্তরালে আরও অনেক ঘটনা থাকে।

বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লড়াই এবং নতুন রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্নের পথ মোটেই মসৃণ হবে না—মন্তব্য করে রিজওয়ানা হাসান বলেন, তার কারণ প্রত্যেকেই প্রত্যেক সিস্টেমে তার ফুটপ্রিন্ট (পদচিহ্ন), সুবিধাভোগী রেখে গেছে। তারা সক্রিয় শক্তি হিসেবে কাজ করছে। অনেক ঘটনা ঘটছে, আবার অনেক সময় ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। তিনি সরকারের ওপর আস্থা রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেন, উপসংহারে যাওয়ার মতো সময় এখনো আসেনি।

অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ ঝাড়ুদারের মতো—এমন মন্তব্য করে এই সরকারের সমাজকল্যাণ এবং মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা শারমিন মুরশিদ বলেন, এখানে অনেক জটিলতা আছে। তিনি জানেন না কতটা কী করতে পারবেন। কিন্তু তাঁরা একটি জায়গা করে দিতে পারবেন। রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের পুনর্গঠন করে নতুন রূপে তরুণদের সামনে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে কেউ রক্ষা করেনি। দলগুলো নিজেদের কাঠামোতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেনি। সেটা করে আস্থা অর্জন করতে হবে।

শারমিন মুরশিদ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো দেশ শাসন করে, নির্বাচন করে তারা ক্ষমতায় যায়। কিন্তু দেশের ইতিহাসে বারবার দেখা গেছে, রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে ক্ষমতার হস্তান্তর হয়নি। তত্ত্বাবধায়ক, অন্তর্বর্তী সরকারের জায়গা তৈরি করে দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। কারণ, তারা এক জায়গায় এসে পৌঁছাতে পারেননি। তাদের অভিন্ন একটি জাতীয় দর্শন, দলগুলোর মধ্যে অংশীদারত্ব নেই।

শারমিন মুরশিদ বলেন, আন্দোলনের সময় ছেলে-মেয়েরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সংগ্রাম করেছে। প্রথম পর্বের যুদ্ধ জয় হয়েছে; কিন্তু যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর নারীদের ওপর নানা হয়রানি শুরু হয়েছে।

উন্মুক্ত আলোচনায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, মৌলিক কিছু বিষয়ে ঐকমত্য আছে, এখানে সংস্কার দরকার। এটি যত দীর্ঘায়িত হবে, বিতর্ক তত বাড়বে। যারা এটাকে নষ্ট করতে চায়, তাদের ভূমিকা বাড়তে থাকবে। তিনি বলেন, কেউ যদি মনে করেন একটি গোষ্ঠী সব সমস্যার সমাধান করে দেবে, তাহলে সেটা সামনে সমস্যা সৃষ্টি করবে। সমাধানের জন্য জনগণের কাছে যেতে হবে। তিনি অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নাগরিক সমাজ সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করেনি। তারা প্রতিবাদ করেছে সুনির্দিষ্ট কিছু বিষয়ে।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ও নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য তোফায়েল আহমেদ বলেন, আন্দোলনের ফসল হলো অন্তর্বর্তী সরকার। সরকার কি কাজ করতে পারবে নাকি পারবে না, হিমালয়ের মতো সমস্যা, আকাশচুম্বী প্রত্যাশা। বলা হচ্ছে এনজিও সরকার। যেভাবে নির্দয়ভাবে সমালোচনা হচ্ছে, তাদের কাজ করা কঠিন।

নিজের কর্মক্ষেত্রের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ল্যান্ডমার্ক ফুটওয়্যার লিমিটেডের চেয়ারম্যান সৈয়দ নাসিম মঞ্জুর বলেন, যাঁরা ভালো করেন, মেধাবী তাঁরা দেশ ছেড়ে চলে যান। তাঁদের দেশে রাখতে ভবিষ্যতে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি আনতে হবে। শুধু বিসিএস দিয়ে তাঁদের ধরে রাখা যাবে না। ২০২৬ সালের মধ্যে যদি উদ্ভাবন ও উৎপাদন বাড়ানো না যায়, তাহলে টিকে থাকা কঠিন হবে।

উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাজিফা জান্নাত বলেন, একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু এই অন্তর্ভুক্তিমূলকের সংজ্ঞা সুনির্দিষ্ট হওয়া দরকার। মানুষ তার মৌলিক অধিকারগুলো চায়। সামাজিক নিরাপত্তা একটি উদ্বেগের জায়গা। অনেকে এ কারণে দেশে থাকতে চান না, বাইরে চলে যান।

অনুষ্ঠানে এবি পার্টির যুগ্ম সদস্যসচিব আসাদুজ্জামান অভিযোগ করেন, আওয়ামী লীগের আমলে নাগরিক সমাজ, বেসরকারি সংস্থাগুলো কোনো প্রতিবাদ করেনি। অনেকে ফ্যাসিবাদের দোসর হিসেবে কাজ করেছে।

তবে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম বলেন, নাগরিক সমাজ হয়তো সবাই একসঙ্গে মিলে প্রতিবাদ করেনি, কিন্তু প্রতিবাদ হয়েছে।

অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ। তিনি বলেন, সামাজিক সংকট, যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য সংকটে সবার আগে নাগরিক সমাজ ঝাঁপিয়ে পড়ে। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকারের জন্য এবং সিস্টেমকে (রাষ্ট্রব্যবস্থা) দরিদ্রদের পক্ষে কাজ করাতে নাগরিক সমাজ নিরলস কাজ করছে। ভবিষ্যতে নাগরিক সমাজের ভূমিকা কী হবে এবং কৌশলগত পরিকল্পনা কীভাবে গড়ে উঠবে, তা নিয়ে আত্মবিশ্লেষণ প্রয়োজন।

উন্মুক্ত আলোচনা পর্ব সঞ্চালনা করেন সিএসও অ্যালায়েন্সের আহ্বায়ক ও গণসাক্ষরতা অভিযানের নির্বাহী পরিচালক রাশেদা কে চৌধূরী। তিনি বলেন, শিক্ষা নিয়ে কী করা হচ্ছে, সে আলোচনা কোথাও শোনা যাচ্ছে না। এখানে গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি বলেন, দেশ সবার। রাজনৈতিক নেতৃত্বের পাশাপাশি নাগরিক সমাজের দায়বদ্ধতা অনস্বীকার্য। সে দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে নাগরিক সমাজ স্বাধীনতার পর থেকে নানাভাবে অবদান রেখে আসছে।

‘বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর: আর্থসামাজিক পরিবর্তনে নাগরিক সংগঠনের ভূমিকা’ শীর্ষক গবেষণাকর্ম থেকে আলোচনা করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। অন্যান্যের মধ্যে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, জামায়াতে ইসলামীর কর্মপরিষদ সদস্য জসিম উদ্দিন সরকার, মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু, একশনএইডের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবির, প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের কান্ট্রি ডিরেক্টর কবিতা বোস, বিডি জবসের সিইও এ কে এম ফাহিম মাশরুর, ছাত্র প্রতিনিধি সৌমিক দত্ত প্রমুখ আলোচনায় অংশ নেন।