একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে লাখো শহীদের সঙ্গে মিশে আছে অসংখ্য বুদ্ধিজীবীরও রক্ত। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের আত্মনিবেদনে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কী ভাবনা তাঁদের সন্তানদের? তাই নিয়ে এই আয়োজন।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানের বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণ শুনে এসে আমার বাবা শহীদ বুদ্ধিজীবী এস এম এ রাশীদুল হাসান তাঁর ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘এতো লোক রমনার মাঠ কখনো দেখেনি। পনের লক্ষাধিক হবে। অসংখ্য স্বেচ্ছাসেবক বাঁশের লাঠি হাতে এসেছেন। স্বাধীনতা ও সংগ্রামের শপথ-স্লোগানে মুখর সভা। কোথাও পাকিস্তানী পতাকা নেই। স্বাধীন বাংলার সুন্দর পতাকায় শোভিত। এমন কখনো দেখিনি।’
বাবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে শিক্ষকতা করতেন। বিজয়ের মাত্র দুই দিন আগে ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা থেকে বাবাকে ধরে নিয়ে যায়। তার ২২ দিন পর বাবার গলিত লাশ মিরপুরের বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। বাবাসহ কয়েকজন শহীদ শিক্ষককে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাহিত করা হয়।
আমার বয়স সে সময় ১২ বছর হবে। সেই বয়সে স্বাধীনতার মর্মার্থ বোঝার ক্ষমতা আমার ছিল না। বড় হয়ে বাবার লেখা ডায়েরিগুলো পড়ে মানুষটি সম্পর্কে জানতে পারি, স্বাধীনতার মর্মার্থও বুঝতে পারি। তিনি ছিলেন অত্যন্ত রাজনীতি ও সমাজ-সচেতন মানুষ, ছিলেন দেশপ্রেমিক ও মানবতাবাদী।
১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি এক বেতার ভাষণে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ঘোষণা করেন, তিনি সামনের নির্বাচনে দাঁড়াবেন না। সেদিন বাবা ডায়েরিতে লিখলেন, ‘দেশের জনগণ ও তাদের স্বার্থ উপেক্ষা করে কেউই বেশি দিন শাসনের আসনে টিকে থাকতে পারে না। সত্যিকার দেশ-শাসকের শক্তির উৎস সব সময় জনগণ, শাসক হবে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, তার ওপর জনগণের আস্থাই হবে তার শক্তির ভিত্তি। সত্যিকার শাসক সব সময় জনগণের সেবক, প্রকৃত প্রস্তাবে খাদেম বা ভৃত্য।’
বাংলা ভাষার প্রতি তাঁর ছিল অগাধ ভালোবাসা। ছিলেন রবীন্দ্রপ্রেমিক। তাঁর স্বপ্ন ছিল মেয়ে বড় হয়ে রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী হবে। পাকিস্তান আমলে রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রনাথের গান গাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। সে সময় রবীন্দ্রসংগীত শিল্পীদের প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে থাকতে হতো। তবু বাবা আমাকে রবীন্দ্রসংগীত শিখতে বুলবুল একাডেমিতে ভর্তি করে দেন।
বাবা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থায় বিশ্বাস করতেন। ১৯৬৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর তিনি ডায়েরিতে লিখেছিলেন, ‘আমাদের দেশে আদর্শ গণতন্ত্র সম্ভব কি না, সে অন্য প্রশ্ন, কিন্তু আজ গণতন্ত্র আছে এ দাবি সত্য নয়। দেশের শক্তি, সুখ ও সুবিধা আজ কতিপয়ের করায়ত্ত। দেশের মানুষ এই অবস্থা চিরকাল মেনে নিতে পারে না। শুক্রবারের স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল এই অবস্থার বিরুদ্ধে অহিংস ও অসহযোগ প্রতিবাদ।’
এই তো কিছুদিন পরই ২৬ মার্চ, আমাদের মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। বাঙালি জাতির ইতিহাসে সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন-সার্বভৌম ‘বাংলাদেশ’ রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা। আমাদের তো ভাবতেই হবে, যাঁরা জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, দেশের জন্য যাঁরা জীবন দিয়েছেন, তাঁরা যে সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন, সে রকম সমাজ কি আমরা গড়তে পেরেছি? আমরা কি বৈষম্যহীন ও মর্যাদাপূর্ণ এমন একটি সমাজ গড়ে তুলতে পেরেছি, যেখানে ভালো মানুষের কদর থাকবে, খারাপেরা নিন্দিত হবে, সর্বক্ষেত্রে মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠা হবে, দুঃখী মানুষদের দুঃখ মোচন হবে। সে রকম কল্যাণকর আমরা রাষ্ট্র তো এখনো প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়েই সেই স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে হবে। সে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি বলেই শহীদের সন্তানেরা সেই স্বপ্ন অন্তরে ধারণ করে সেসব বাস্তবায়নের প্রত্যাশায় অপেক্ষা করে আছে।
মুক্তিযুদ্ধের গভীরে ছিল স্বাধীনতা, মানবিক মর্যাদা এবং সামাজিক ন্যায়ের প্রতি অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকারে উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের মানুষের জন্য একতার পরিবেশ সৃষ্টি করা। এই একতা আমরা কতটা অর্জন করতে পারলাম?
রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে আমরা স্বাধীন হয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতেই আমাদের বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি গড়ে তুলতে হবে।
রোকাইয়া হাসিনা: রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী এবং শহীদ বুদ্ধিজীবী এস এম এ রাশীদুল হাসানের মেয়ে