পঙ্কজ ভট্টাচার্য ছিলেন রাজনীতির বাতিঘর। তিনি ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করেননি। তাঁর আদর্শ ছিল উদার অসাম্প্রদায়িক মানবিক গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ করা।
গত শতকের ষাটের দশকের অন্যতম ছাত্রনেতা, রাজনীতিবিদ, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক পঙ্কজ ভট্টাচার্যের নাগরিক স্মরণসভায় তাঁকে নিয়ে এসব কথা বলেন বিশিষ্টজনেরা।
নাগরিক স্মরণসভা জাতীয় কমিটি আয়োজিত এই সভায় আলোচনা, স্মৃতিচারণা, আবৃত্তি, গান আর পুষ্পাঞ্জলিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় পঙ্কজ ভট্টাচার্যের প্রতি।
রাজধানীর জাতীয় জাদুঘরের বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব মিলনায়তনে ছুটির দিন গতকাল শুক্রবার বেলা সাড়ে তিনটায় স্মরণসভা শুরু হয়। শুরুতেই মঞ্চে রাখা পঙ্কজ ভট্টাচার্যের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করে প্রায় ৪০টি সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক ও পেশাজীবী সংগঠন। ব্যক্তিগত পর্যায়ে অনেকে শ্রদ্ধা জানান। এ সময় তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হকের লেখা পঙ্কজ ভট্টাচার্যের সংক্ষিপ্ত জীবনী পাঠ করেন সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের নেতা এ কে আজাদ। এতে বলা হয়, পঙ্কজ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৩৯ সালের ৬ আগস্ট চট্টগ্রামের রাউজানের নোয়াপাড়ায়। তিনি দেশব্রতী পরিবারে বড় হয়েছেন। জাগতিক মোহ বিবর্জিত হয়ে তিনি দেশ ও সমাজের কল্যাণে কাজ করেছেন। পঙ্কজ ভট্টাচার্য ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। জেল-জুলুম সহ্য করে কাজ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন। ২০২৩ সালের ২৪ এপ্রিল তিনি জীবনের শেষদিন অবধি আদর্শে অটল থেকেছেন।
আলোচনা ও স্মৃতিচারণা পর্ব শুরু হয় স্মরণসভা জাতীয় কমিটির আহ্বায়ক নাট্যজন রামেন্দু মজুমদারের সূচনা বক্তব্যের মাধ্যমে। তিনি বলেন, কিছু কিছু মানুষ জন্মগ্রহণ করেন, যাঁরা মানুষকে দেওয়ার জন্যই আসেন, কিছু পাওয়ার জন্য নয়। পঙ্কজ ভট্টাচার্য ছিলেন তেমনি একজন। তাঁর মতো রাজনীতিক আজকের দিনে বিরল। জাতীয় কমিটির উদ্যোগে তাঁর স্মরণে একটি স্মারকগ্রন্থ ও তাঁর জীবনের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে তিনি জানান।
জাতীয় কমিটির অপর আহ্বায়ক মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারওয়ার আলী বলেন, পঙ্কজ ভট্টাচার্য ছিলেন অজাতশত্রু। সারা জীবন অসাম্প্রদায়িক মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করে গেছেন। সমাজকে দুর্বৃত্তায়ন মুক্ত করতে তাঁর চেষ্টা ছিল প্রশ্নাতীত।
আলোচনা পর্বে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন হুইলচেয়ারে দর্শক আসনে বসেই তাঁর বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে পঙ্কজ ভট্টাচার্য নির্ভীকভাবে অবস্থান নিয়েছেন। ভয় দেখিয়ে বা লোভ দেখিয়ে তাঁকে আদর্শ থেকে বিচ্যুত করা যায়নি।
ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও সংসদ সদস্য রাশেদ খান মেনন স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘ষাটের দশক থেকে পঙ্কজ ভট্টাচার্যের সঙ্গে রাজনীতি করেছি। অনেক সময় মতের মিল হয়নি। কিন্তু সব সময় একটি বৃহৎ বাম গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যের চেষ্টা করে গেছেন তিনি।’
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেন, ‘এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি রাজনীতি ও সমাজ যেন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। ক্রমেই এই দূরত্ব বাড়ছে। কিন্তু পঙ্কজ ভট্টাচার্য রাজনীতির প্রথম সারিতে থেকেও সমাজবিচ্ছিন্ন হননি।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ তাঁর দল ও সরকারের পক্ষ থেকে পঙ্কজ ভট্টাচার্যের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। তিনি বলেন, বর্তমান সময়ে পঙ্কজ ভট্টাচার্যের মতো সব মহলের শ্রদ্ধেয় রাজনীতিক খুব কম আছেন।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি শাহ আলম বলেন, ষাটের দশকের ছাত্ররা যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন, তার চূড়ান্ত পরিণতি পেয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের ভেতর দিয়ে। সেখানে পঙ্কজ ভট্টাচার্য অনন্য ভূমিকা রেখেছেন।
পঙ্কজ ভট্টাচার্যের পরিবারের পক্ষে আলোচনায় অংশ তাঁর স্বজন মানস কুমার বসু। তিনি বলেন, পঙ্কজ ভট্টাচার্যের মানসিক শক্তি ছিল প্রবল। কখনো কোনো পরিস্থিতিতে ভেঙে পড়েননি।
অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করেন ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়। কবিতা পাঠ করেন কবি মুহাম্মদ সামাদ। গান গেয়ে শুনিয়েছেন মহুয়া মঞ্জুরী, বর্ষা, রাহা, ঋদ্ধি ঋত্বিকা বসু, নম্রতা মনস্বী বসু ও জিনাত ফেরদৌস।
অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন বলেন, পঙ্কজ ভট্টাচার্য ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করেননি। রাজনীতি তাঁর কাছে ছিল সমাজ বদলের হাতিয়ার।
বাংলাদেশ জাসদের সভাপতি শরীফ নূরুল আম্বিয়া, ঐক্য ন্যাপের এস এম এ সবুর, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত, গণফোরামের সুব্রত চৌধুরী, গণতন্ত্রী পার্টির শহিদুল্লাহ সিকদার, সমকাল সম্পাদক মোজাম্মেল হোসেন মঞ্জু, মহিলা পরিষদের ফওজিয়া মোসলেম, আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং, জাতীয় প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক শ্যামল দত্ত, অধ্যাপক সাদেকা হালিম, সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদবিরোধী মঞ্চের নূর মোহাম্মদ তালুকদার, সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দীলিপ বড়ুয়া, সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলনের সাধারণ সম্পাদক সালেহ আহমেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস প্রমুখ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।