জনবহুল ও নিচু এলাকায় ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা ও জনসম্পৃক্ততার ওপর জোর।
জনবহুল এলাকা এবং অপেক্ষাকৃত নিম্নাঞ্চলে ডেঙ্গুর বিস্তার ঘটছে বেশি, বিশেষ করে যেসব এলাকার বসতবাড়ির চেয়ে রাস্তা উঁচু। এমনটা হওয়ার কারণে বিভিন্ন বাসাবাড়ির নিচতলায় পানি জমে থাকে। হয়ে ওঠে ডেঙ্গুর জন্য দায়ী এডিস মশার সবচেয়ে বড় প্রজননস্থল। শুধু রাজধানীতে নয়, এমন অবস্থা অন্য শহরগুলোতেও। অন্তত পাঁচ বছরের প্রায় প্রতিবারেরই এডিস মশা প্রজননের বড় উৎসস্থল ছিল ভবনের মেঝে বা ছাদ।
কীটতত্ত্ববিদ, জনস্বাস্থ্যবিদ ও নগরবিদেরা বলছেন, নগরে এডিসের বিস্তার অন্তত তিনটি প্রবণতা তুলে ধরে। এক. অপরিকল্পিতভাবে নগরায়ণ হচ্ছে। দুই. ডেঙ্গু প্রতিরোধে যথাযথ প্রচারের যথেষ্ট অভাব আছে। তিন. এডিসের বংশবিস্তার রোধে সংশ্লিষ্ট নানা কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাব আছে।
অপরিকল্পিত নগরায়ণ আমাদের বাস্তবতা। কিন্তু একে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আনার কোনো প্রচেষ্টাই দেখছি না।বে-নজির আহমেদ, সাবেক পরিচালক, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা
২১ আগস্ট সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সঙ্গে বৈঠকে ডেঙ্গু নিয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সেখানে চলতি বছর ঢাকার দুই সিটি এলাকার মশার লার্ভা জরিপের ফলাফল তুলে ধরা হয়। এতে এডিসের নানা উৎসস্থলের লার্ভা পাওয়ার তথ্য উঠে আসে। দেখা যায়, দুই সিটিতে সবচেয়ে বেশি প্রায় ১৬ শতাংশ ক্ষেত্রে লার্ভা পাওয়া গেছে বসতবাড়ির মেঝেতে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এটা বাড়ির নিচতলায় জলমগ্ন এলাকায় বেশি পাওয়া গেছে। কিছু পাওয়া গেছে বেজমেন্টে। আবার কিছু পাওয়া গেছে ছাদে। মেঝে ও ছাদের পরই এডিসের লার্ভার বড় উৎস প্লাস্টিকের ড্রাম।
গত বছরের (২০২২) একাধিক লার্ভা জরিপেও বড় দুই উৎস ছিল মেঝে ও প্লাস্টিকের ড্রাম। প্রায় ২৪ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রজননস্থল ছিল এই দুই স্থান। ২০২০ সাল বাদ দিলে ২০১৯ ও ২০২১ সালেও এডিসের সবচেয়ে বড় প্রজননস্থল ছিল মেঝেতে জমা পানি। রাজধানীর যেসব এলাকায় ডেঙ্গুর বিস্তার সবচেয়ে বেশি হয়েছে, দেখা গেছে সেসব এলাকা সেখানকার সড়কের তুলনায় অপেক্ষাকৃত নিচু।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজির আহমেদ গতকাল রোববার প্রথম আলোকে বলেন, ‘দিনের পর দিন একটি অভিন্ন উৎস মশার প্রধান প্রজননক্ষেত্র হয়ে ওঠা সিটি করপোরেশনসহ স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর ধারাবাহিক নজরদারির অভাবকে তুলে ধরে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ আমাদের বাস্তবতা। কিন্তু একে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আনার কোনো প্রচেষ্টাই দেখছি না। আবার যেভাবে মশা নিধন অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে, সেটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রমাণভিত্তিক হয় না। সিটি করপোরেশনগুলোর চিরুনি অভিযানের নামে সামনে যা পায়, সেখানে মশার ওষুধ ছিটায়। কোন এলাকায় পানি জমে আছে, সে তথ্যের ভিত্তিতে এসব কাজ হয় না।’
যেখানে জনঘনত্ব বা মশার ঘনত্ব বেশি, সেখানে সংক্রমণের ঝুঁকিও বেশি। কারণ, কাছাকাছি বেশি লোক থাকলে একই মশা একাধিকজনকে কামড়াতে পারে। এ জন্য মানুষের সুরক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে, মশাও নির্মূল করতে হবে।কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার
দেশের এযাবৎ মোট ডেঙ্গু আক্রান্তের ৪৮ শতাংশই ঢাকা নগরীর বাসিন্দা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার এক জরিপে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ১ আগস্ট পর্যন্ত রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি ১৭ শতাংশ ডেঙ্গু রোগী যাত্রাবাড়ী এলাকার। এরপরই আছে সবুজবাগ। এখানে মোট রোগীর প্রায় ১৩ শতাংশের বাস। ঢাকার অন্য এলাকাগুলোর মধ্যে আছে কদমতলী, মোহাম্মদপুর, খিলগাঁও, কেরানীগঞ্জ, ক্যান্টনমেন্ট, উত্তরা, ধানমন্ডি ও পল্লবী।
নগর গবেষক ইকবাল হাবীব প্রথম আলোকে বলেন, যাত্রাবাড়ী থেকে শুরু করে মিরপুর পর্যন্ত কাজী নজরুল ইসলাম সরণি, মিরপুর সড়ক এবং শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সরণির দুই পাশ অর্থাৎ পূর্ব ও পশ্চিম দিকের এলাকাগুলো মূলত নিম্নাঞ্চল। রাস্তা উঁচু এবং পার্শ্ববর্তী এলাকা নিচু হওয়ায় অনেকটা কচ্ছপের পিঠের মতো ঢালু অবস্থা তৈরি হয়েছে।
সে জন্য পানি জমে এসব এলাকায় জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে, যা ডেঙ্গু বিস্তারে সহায়তা করছে। কিন্তু এসব এলাকায় সড়কের উচ্চতাও নিম্নাঞ্চলের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া উচিত। বাস্তবে হয়েছে তার উল্টো। আমাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, যাত্রাবাড়ী ও সবুজবাগ এলাকা জনবহুল হওয়ার পাশাপাশি এসব এলাকার অনেক বাড়ি রাস্তার নিচে অবস্থিত। এতে এসব এলাকায় পানি জমে থাকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখা গত জুলাই ও আগস্ট মাসে ঢাকার পাশের দুই নগরে লার্ভা জরিপ করে। জরিপে দেখা যায়, গাজীপুরে ১৪ শতাংশ বাড়িতে আর নারায়ণগঞ্জে ১৩ শতাংশের বেশি বাড়িতে লার্ভা পাওয়া যায়। এডিস মশার লার্ভার ঘনত্ব পরিমাপের স্বীকৃত পদ্ধতি হলো ‘ব্রুটো ইনডেক্স (বিআই)’। এই মানদণ্ডে লার্ভার ঘনত্ব ২০ শতাংশের বেশি হওয়া মানে সেখানে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব নিশ্চিতভাবে বেড়ে গেছে।
নারায়ণগঞ্জের ২৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১১টির বিআই ২০ বা এর বেশি। ওয়ার্ডগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ১৪ নম্বর ওয়ার্ড, এর বিআই ১১৩।
জরিপে অংশ নেওয়া স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের একটি ঘরের সঙ্গে আরেকটি ঘর লেগে আছে। পুরো অস্বাস্থ্যকর অবস্থা। নগরের মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীও বলেন, এ ওয়ার্ডটি সবচেয়ে জনবহুল।
যাত্রাবাড়ী এলাকাটি নগরীর ডেঙ্গুর ‘হটস্পট’ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এ তথ্য মানতে রাজি নন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির। তিনি বলেন, ‘আমরা বিশ্লেষণ করে দেখেছি, যাত্রাবাড়ী থেকে যেসব ডেঙ্গু রোগী এসেছেন, তাঁদের অনেকেই সেখানকার বাসিন্দা নন। অন্য এলাকা থেকে এসে সেবা নেওয়ার জন্য সেখানকার নাম ব্যবহার করেছেন। তাই যাত্রাবাড়ীতে বেশি সংক্রমণ হয়েছে এ তথ্য নিয়ে আমাদের আপত্তি আছে।’
বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখেছি, নিচতলায় শুধু পিলার দিয়ে বাড়ি করা হয়েছে। নিচতলা একটা চৌবাচ্চা হয়ে আছে। রাস্তার চেয়ে নিচু এলাকার পানি এসব স্থানে গিয়ে জড়ো হচ্ছেস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক প্রধান কীটতত্ত্ববিদ মো. খলিলুর রহমান
তবে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা মুশতাক হোসেন মনে করেন, একটি সুনির্দিষ্ট এলাকাতেই শুধু বাইরের লোক এসে চিকিৎসা নেবেন, এটা মেনে নেওয়া শক্ত। নগর কর্তৃপক্ষের উচিত, এসব কথা না বলে একটি এলাকার রোগের কারণ নির্ণয় করা এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া। তাহলে নগরে ডেঙ্গুর বিস্তার রোধ সম্ভব হবে।
অপরদিকে গাজীপুরে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ওয়ার্ড ৪৬। এখানকার জনসংখ্যার আধিক্য এবং কিছু এলাকায় জলাবদ্ধতার কথা জানান নগরীর ভারপ্রাপ্ত মেয়র আসাদুর রহমান।
ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরের লার্ভা জরিপে ছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক প্রধান কীটতত্ত্ববিদ মো. খলিলুর রহমান। তিনি বলেন, ‘বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখেছি, নিচতলায় শুধু পিলার দিয়ে বাড়ি করা হয়েছে। নিচতলা একটা চৌবাচ্চা হয়ে আছে। রাস্তার চেয়ে নিচু এলাকার পানি এসব স্থানে গিয়ে জড়ো হচ্ছে।’
জনঘনত্ব কীভাবে এডিসের বিস্তার ঘটায়, জানতে চাইলে কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, যেখানে জনঘনত্ব বা মশার ঘনত্ব বেশি, সেখানে সংক্রমণের ঝুঁকিও বেশি। কারণ, কাছাকাছি বেশি লোক থাকলে একই মশা একাধিকজনকে কামড়াতে পারে। এ জন্য মানুষের সুরক্ষার ব্যবস্থা রাখতে হবে, মশাও নির্মূল করতে হবে।
জনবহুল ও নিচু এলাকায় ডেঙ্গু বিস্তার রোধে ওই সব এলাকার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন। গতকাল রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মশা নির্মূল ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় মানুষকে সম্পৃক্ত করা জরুরি, যা এখনো অনুপস্থিত। সংক্রমণ ঝুঁকির মধ্যে যে জনগোষ্ঠী আছে, তাদের চিহ্নিত করে আগাম ব্যবস্থা নিতে হবে।