ফেসবুকে পোস্ট করা একটি ‘গ্রাফিক কার্ডে’ অসংগতির জন্য প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান ও নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করায় বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের সমালোচনা হচ্ছে বলে ভয়েস অব আমেরিকার একটি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বুধবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় সোচ্চার ব্যক্তিরা বলছেন, সংবাদমাধ্যম-সংক্রান্ত অভিযোগ মীমাংসার জন্য প্রেস কাউন্সিলে না গিয়ে কর্তৃপক্ষ দ্রুত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার করছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শামসুজ্জামান গত সপ্তাহে যখন জামিনে কারাগার থেকে বেরিয়ে আসেন, তখন তাঁর সহকর্মীরা বাংলাদেশি এই সাংবাদিকের গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেন।
শামসুজ্জামান দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার প্রতিবেদক। খাদ্যপণ্যের দাম নিয়ে ‘ভুয়া খবর’ প্রকাশের অভিযোগে তাঁকে ছয় দিন ঢাকার কারাগারে কাটাতে হয়েছে।
এখন তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দুটি মামলা চলছে। তার একটি মামলায় প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানকেও আসামি করা হয়েছে। এমন সময়ে শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হল যখন বিশ্লেষকেরা বাংলাদেশে আইনের মাধ্যমে সাংবাদিকদের হয়রানির ঘটনা বৃদ্ধির বিষয়ে কথা বলছেন।
ভয়েস অব আমেরিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকর হয় ২০১৮ সালে। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল অনলাইনে প্রকাশিত খবর, তথ্য–উপাত্তের মাধ্যমে যেন দেশের মানহানি ও ক্ষতি না হয় সেই সুরক্ষা নিশ্চিত করা।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষায় সোচ্চার ব্যক্তিরা বলছেন, এই আইনের কিছু ধারা রয়েছে যেগুলো বিস্তৃত পরিসরে প্রয়োগ করা যায়। এই সুযোগ নিয়ে কর্তৃপক্ষ সেগুলো সমালোচকদের চুপ করিয়ে দিতে এবং স্বাধীন মতপ্রকাশকে দমিয়ে রাখতে ব্যবহার করছে। এই আইনের আওতায় বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি সুযোগ রয়েছে এবং এ আইনের মামলায় কেউ দোষী সাব্যস্ত হলে ১৪ বছর পর্যন্ত সাজার বিধান রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ১ হাজার ২৯টি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলার আসামিদের মধ্যে ৩০১ জন রাজনীতিবিদ এবং ২৮০ জন সাংবাদিক রয়েছেন।
শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি প্রথম আলোর ফেসবুক পেজে পোস্ট করা একটি গ্রাফিক কার্ডে অসংগতি ঘিরে। প্রথম আলো কর্তৃপক্ষের ভাষ্যমতে, তারা ওই অসংগতি দ্রুত সংশোধন করার চেষ্টা করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে জীবনযাত্রা নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন শামসুজ্জামান।
২৬ মার্চ প্রথম আলো অনলাইনে প্রতিবেদনটি প্রকাশের পর সেখানে উল্লেখিত একজন দিনমজুরের উদ্ধৃতিসহ একটি গ্রাফিক কার্ড নিজেদের ফেসবুক পেজে পোস্ট করে। তবে দিনমজুরের পরিবর্তে গ্রাফিক কার্ডে একটি শিশুর ছবি যায়।
শামসুজ্জামানের প্রতিবেদনে ওই শিশুর কথাও ছিল বলে জানিয়েছেন পত্রিকাটির নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ।
ভয়েস অব আমেরিকাকে সাজ্জাদ শরিফ বলেন, ‘পাঠককে বিভ্রান্ত করতে পারে সে আশঙ্কা থেকে পোস্ট দেওয়ার পরপরই আমরা ফেসবুক পেজ থেকে গ্রাফিক কার্ডটি সরিয়ে নিই। আর অনলাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদনের নিচে একটি সংশোধনী নোটও দেওয়া হয়েছিল।’
প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হাসান বলেন, অসংগতির কারণে গ্রাফিক কার্ডটি প্রত্যাহার করা হলেও প্রতিবেদনটি ঠিক ছিল।
ওই ঘটনার তিন দিন পর ২৯ মার্চ ভোর রাতে ঢাকার সাভারে শামসুজ্জামানের বাসায় যান এক ডজনের বেশি কর্মকর্তা। দলটির সদস্যরা এই সাংবাদিকের বাসা তল্লাশি করেন। তাঁরা একটি ল্যাপটপ, মুঠোফোন ও কম্পিউটারের হার্ড ডিস্ক জব্দ করেন এবং তাঁকে আটক করেন।
এ বিষয়ে বক্তব্যের জন্য বাংলাদেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে ইমেইল করে তাৎক্ষণিক কোনো জবাব পায়নি ভয়েস অব আমেরিকা।
শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করার কয়েক ঘণ্টা পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছিলেন, এই সাংবাদিক অসন্তোষ সৃষ্টির অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে প্রকৃত ঘটনাকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছেন। আইনমন্ত্রী বলেছিলেন, সংবাদমাধ্যমটির বিরুদ্ধে মামলা সরকার করেনি এবং আইন ‘তার নিজস্ব গতিতে চলবে’।
সাজ্জাদ শরিফ প্রশ্ন তুলেছেন, এ বিষয়টি প্রেস কাউন্সিলে না পাঠিয়ে তাঁর সহকর্মীদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা কেন দেওয়া হল, যেখানে প্রেস কাউন্সিল এ ধরনের অভিযোগের নিষ্পত্তি করে থাকে।
প্রেস কাউন্সিল সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ পর্যালোচনা করে থাকে। অভিযোগের তদন্ত এবং সতর্ক করার ক্ষমতা রয়েছে এই প্রতিষ্ঠানের।
লেখক-সাহিত্যিক, ব্লগার ও সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন পেন ইন্টারন্যাশনালের বাংলাদেশ শাখার মহাপরিচালক সৈয়দা আইরিন জামান ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেছেন, শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তারের ঘটনাটি সবার মধ্যে ভয় ধরিয়ে দেওয়ার একটি চেষ্টা বলে তিনি মনে করেন।
যে ঘটনার জন্য শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সে বিষয়ে আইরিন জামান বলেন, ‘এটা ছিল নিছক একটি ভুল। তার বেশি কিছু নয়। সাংবাদিকতার দৃষ্টিকোণ থেকে তা ছিল সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত।’
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আইরিন জামান বলেন, ‘আমি বলতে চাই যে এটি একটি কঠোর আইন, যেটা সরকার তৈরি করেছে এমন ব্যক্তিদের নিশানা করার জন্য, যাঁদের তারা কোনো যৌক্তিক কারণ ছাড়াই অপছন্দ করে। শুধু এ কারণে যে এসব ব্যক্তি সত্য কথা বলেন।’
যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন আর্টিকেল নাইনটিনের আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সাল ভয়েস অব আমেরিকাকে বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিয়ে সংগঠনটি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা বাড়তে দেখাটা খুবই হতাশাজনক।’
ফারুখ ফয়সাল বলেন, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা ‘ভয়ের পরিবেশ’ সৃষ্টির ঝুঁকি তৈরি করে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে সরকারের পক্ষে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
বিশ্বব্যাপী সাংবাদিকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারসের (আরএসএফ) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে বৈশ্বিক গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকে ১০ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ। সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬২তম।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে সাংবাদিকদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর আইনগুলোর একটি হিসেবে বর্ণনা করে আরএসএফ বলেছে, গণমাধ্যমকর্মীদের কারাবন্দী করার জন্য প্রায়ই এই আইন ব্যবহার করা হয়ে থাকে।