খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সহিংসতার সময় হামলার ঘটনা যেমন ঘটেছে, তেমনি ছড়িয়েছে ভুয়া ও অপতথ্যও। ১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বর ওই দুই জেলায় মোট পাঁচজন নিহত হন (বাঙালি যুবকসহ)। যদিও অপতথ্য ছড়ানো কিছু ফেসবুক পেজ, এক্স হ্যান্ডল (টুইটার) এবং ইউটিউব চ্যানেলে নিহতের সংখ্যা অনেক বেশি বলে দাবি করা হয়। কোথাও কোথাও বলা হয়, নিহত হয়েছেন ১০০ জনেরও বেশি।
খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে সাম্প্রতিক সহিংসতা নিয়ে তথ্য যাচাইকারী বা ফ্যাক্ট চেক প্রতিষ্ঠান ডিসমিসল্যাবের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। ‘৪ থেকে ১০০: পাহাড়ে সহিংসতায় অপতথ্যের রাজনীতি’ শিরোনামের প্রতিবেদনে তারা বলছে, অপতথ্য ছড়ানোর সঙ্গে বাংলাদেশি দাবি করা ব্যক্তিরা যেমন ছিলেন, তেমনি ছিল ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলের কিছু অনলাইন পোর্টাল ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আইডি (প্রোফাইল)।
খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় ১৮ সেপ্টেম্বর মোটরসাইকেল চুরির অভিযোগে মো. মামুন নামের এক বাঙালি যুবককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এর জেরে পরদিন দীঘিনালায় পাহাড়ি-বাঙালিদের মধ্যে সহিংসতা হয়। ওই দিন দীঘিনালায় মারধর করে হত্যা করা হয় ধনঞ্জয় চাকমা নামের এক ব্যক্তিকে। রাতে সদরে গোলাগুলি হয়। এ সময় নিহত হন তিনজন পাহাড়ি যুবক।
২০ সেপ্টেম্বর আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) এক প্রেসনোটে বলা হয়, ১৯ সেপ্টেম্বর রাতে খাগড়াছড়ি জোনের একটি টহল দল একজন মুমূর্ষু রোগীকে স্থানান্তরের সময় শহরের স্বনির্ভর এলাকায় পৌঁছালে ইউপিডিএফের সন্ত্রাসীরা গুলি চালায়। আত্মরক্ষার্থে সেনাবাহিনীর সদস্যরাও পাল্টা গুলি চালান। গোলাগুলিতে তিনজন নিহত এবং কয়েকজন আহত হন।
ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদন বলছে, দীঘিনালায় ১৯ সেপ্টেম্বর রাত সাড়ে ১০টার দিকে সংঘর্ষ শুরু হলে এর আড়াই ঘণ্টার মধ্যে (রাত ১২টা ৫৪ মিনিট) জুম্ম নামে একটি ফেসবুক পেজ থেকে দাবি করা হয়, খাগড়াছড়িতে এরই মধ্যে প্রাণ হারিয়েছে ৩২ জন। ওইদিন আরসি’স ওয়ার্ল্ড নামের দেশের বাইরে থেকে পরিচালিত আরেকটি ফেসবুক পেজ থেকে লেখা হয় ‘বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর হামলায় পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃ–গোষ্ঠীর অন্তত ৩৫ জন নিহত হয়েছেন।’ এই পোস্টের সঙ্গে সংযুক্ত করে দেওয়া হয় গুলি করার ভিডিও এবং স্থিরচিত্র। যেখানে দেখা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত কয়েকজনের ছবি। কিন্তু সেখানে কোনো মৃতদেহের ছবি ছিল না।
ডিসমিসল্যাব বলছে, জুম্ম নামের ফেসবুক পেজটি তৈরি করা হয়েছে ঘটনার এক দিন আগে, ১৮ সেপ্টেম্বর। এই পেজের আইডিতে ব্যবহার করা ছবিটি আসলে ভারতের ত্রিপুরার অনলাইনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য জুম্ম টাইমসের লোগো।
ডিসমিসল্যাব তাদের প্রতিবেদনে রাঙামাটির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শাহনেওয়াজ রাজুর বক্তব্য তুলে ধরেছে। তিনি বলেন, প্রাণহানির এই সংখ্যা পুরোপুরি ভিত্তিহীন এবং এ ধরনের তথ্য পাহাড়ের পরিস্থিতিকে আরও অশান্ত করে তোলে।
ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে রূপম নামের আরেকজন ভারতীয় পরিচয়দানকারী ইনফ্লুয়েন্সারের কথা বলা হয়েছে। ‘রূপম দ্য এক্সপ্লোরার’ নামে পেজে একটি ভিডিওতে শিরোনাম দিয়েছেন, ‘বাংলাদেশি মুসলিমদের হাতে নৃশংসভাবে শতাধিক ব্যক্তি নিহত; আফগানিস্তানের পথে হাঁটছে বাংলাদেশ।’ ভিডিওটিতে মন্তব্য এসেছে সাড়ে তিন শর বেশি মানুষের। সেটি শেয়ার হয়েছে ৩০ হাজারের বেশিবার।
ডিসমিসল্যাব বলছে, হিল ব্লাড, বাবা বেনারস, ভয়েস অব বাংলাদেশি হিন্দুজসহ বিভিন্ন ফেসবুক পেজ ও এক্স হ্যান্ডল থেকে মৃত্যুর ভুয়া সংখ্যা প্রচার করা হয়েছে। ভারতের ত্রিপুরায় অনুষ্ঠিত বিক্ষোভের সময়ও বাংলাদেশে পাহাড়ের সংঘর্ষের ঘটনায় মৃত্যুর ভুয়া সংখ্যা বলা হয়েছে। দেশটির বিভিন্ন সুপরিচিত গণমাধ্যম সেটা ধরে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
ডিসমিসল্যাবের প্রতিবেদনে পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি অঙ্কন চাকমাকে উদ্ধৃত করা হয়। তিনি বলেন, মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রাণহানির সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে, যা পাহাড়ে অনেক আতঙ্ক ছড়িয়েছে।
প্রাণহানির ভুল সংখ্যা ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির আঞ্চলিক নেতারা কিছু ক্ষেত্রে ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশে সদ্য ক্ষমতাচ্যুত দল আওয়ামী লীগ নেতা–কর্মীদের রাজনৈতিক প্রচারণায়ও তা ব্যবহার করা হয়েছে।
বাংলাদেশে পাহাড়ে সহিংসতা নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কাছে পৃথকভাবে স্মারকলিপি দেয় বিজেপি মিজোরাম সিএডিসি কমিটি এবং ত্রিপুরা স্টেট লেভেল চাকমা ইয়ুথ অর্গানাইজেশন। স্মারকলিপিতে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনী এবং অবৈধ বাঙালি বসতি স্থাপনকারীরা হামলা চালাচ্ছে। খাগড়াছড়িতে অন্তত ৯ জন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এসব সংগঠনের সমর্থকেরা বিভিন্ন পেজ ও এক্স হ্যান্ডলে এটিকে গণহত্যা এবং ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী/জাতিগত নির্মূল অভিযান বলে উল্লেখ করেন এবং জাতিসংঘ ও যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ দাবি করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেন।
বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরুপা দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, ‘রিউমারই (গুজব) সহিংসতা ছড়িয়ে যাওয়ার একমাত্র কারণ বলে আমি মনে করি না।’ তিনি বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই পাহাড়ে বাঙালির কিছু ঘটলেই আমরা আতঙ্কিত হয়ে যেতাম। এবং সত্যি সত্যি একই সহিংসতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে আরেকটি বড় ঘটনা ঘটে যেত। এর কারণ বিচারহীনতার সংস্কৃতি।’
নিরুপা দেওয়ান আরও বলেন, পাহাড়ের কিছু হলে মামলা হয়, কিন্তু শাস্তি হয় না। প্রশাসন যথাযথভাবে দায়িত্ব পালন করলে এমন হওয়ার কথা নয়।