জঙ্গিবাদে জড়ানোর শঙ্কা

‘নিখোঁজ’ এত তরুণ গেল কোথায়

হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার পাঁচ বছর পর নতুন করে তরুণদের ঘর ছাড়ার ঘটনা বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে।

  • নতুন করে নিখোঁজ ৫০-এর বেশি তরুণ।

  • গত নভেম্বর থেকে আগস্টের মধ্যে ঘর ছাড়েন তাঁরা। 

  • কুমিল্লা, পটুয়াখালী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও সিলেট থেকে নিখোঁজ বেশি।

বাঁ থেকে মো. নেছার উদ্দিন, ইব্রাহিম, মো. মিরাজ, মো. হোসাইন। নিচে বাঁ থেকে রাকীব হাসনাত, মো. সাবিথ, জাহেদ চৌধুরী ও রোমান শিকদার

জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ‘হিজরত’–এর নামে ঘরছাড়া তরুণের সংখ্যা বাড়ছে। দেশের বিভিন্ন এলাকার অর্ধশতাধিক তরুণ নতুন করে এ পথে পা বাড়িয়েছেন বলে জানা গেছে। হোলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার পাঁচ বছর পর নতুন করে ‘হিজরতের’ এ প্রবণতা উদ্বেগের বড় কারণ হয়ে উঠেছে বলেও মনে করা হচ্ছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চলতি বছরের শুরুর দিক থেকে নতুন করে তরুণদের বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে একটি জঙ্গিগোষ্ঠী। তারা হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলায় জড়িত আইএস মতাদর্শী জঙ্গিগোষ্ঠী নয় বলে ওয়াকিবহাল একটি সূত্র জানিয়েছে। সূত্রটির মতে, এ জঙ্গিদের কার্যক্রমের সঙ্গে আল–কায়েদা মতাদর্শী আনসার আল ইসলামের কার্যক্রমের সামঞ্জস্য রয়েছে।

হোলি আর্টিজানে হামলাকারীরা সবাই এভাবে ঘর ছেড়েছিল। এখন আবার বেশ জোরেশোরে হিজরতের নামে বের হচ্ছে। এদের যদি খুঁজে বের করতে না পারি, এটা দুশ্চিন্তার কারণ হবে।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন, পরিচালক, র‌্যাব (গণমাধ্যম ও আইন শাখা)

গত মাসের শেষ দিকে কুমিল্লা থেকে নিখোঁজ সাত কলেজছাত্রের বিষয়ে অনুসন্ধানে নেমে নতুন করে ‘হিজরত’–এর (দেশত্যাগ বা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যাওয়া) বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরে আসে। এরপর পটুয়াখালী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গোপালগঞ্জের আরও সাতজনের দুই থেকে তিন মাস ধরে নিরুদ্দেশ হওয়ার খবর পাওয়া যায়।

এর আগে গত বছরের ১৫ নভেম্বর থেকে সিলেটের চার তরুণ শেখ আহমেদ মামুন (২৩), মো. হাসান সায়িদ (২৪), সাইফুল ইসলাম তুহিন (২৪) ও মো. সাদিকুর রহমান (৩৩) নিখোঁজ রয়েছেন। তাঁদের সন্ধানে পুলিশ ও র‍্যাব কাজ করছে বলে জানা গেছে।

র‍্যাব সূত্র বলছে, তাদের প্রাপ্ত গোয়েন্দা তথ্যানুযায়ী, কুমিল্লার সাত তরুণ ও সিলেটের চার তরুণ এবং সর্বশেষ পটুয়াখালী, ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও গোপালগঞ্জের তরুণদের নিখোঁজ হওয়া একই সূত্রে গাঁথা।

জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন একটি সূত্র জানায়, কুমিল্লার পর পটুয়াখালীসহ অন্যান্য এলাকা থেকে নিখোঁজ তরুণদের সন্ধানে নেমে ৫০ জনের বেশি তরুণের ঘর ছাড়ার তথ্য পাওয়া গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন প্রথম আলোকে বলেন, কুমিল্লার সাত তরুণ নিখোঁজের খবর পাওয়ার পর গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আরও চারজনের ওপর নজরদারি করে র‍্যাব। ওই চারজনও হিজরতে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। র‌্যাব তাঁদের হেফাজতে নিয়ে পরে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে। ওই চারজন র‍্যাবকে জানিয়েছিলেন যে আরও বেশ কয়েকজন তরুণ হিজরতে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন বা পরিকল্পনা করছেন। বিভিন্ন সূত্র ও গোয়েন্দা তথ্যানুযায়ী, এ মুহূর্তে হিজরতে থাকা তরুণের সংখ্যা বেশ কয়েকজন হবে। তিনি বলেন, অনেক পরিবারই তথ্য গোপন করে বা তথ্য দিতে চায় না। পরিবারগুলো তথ্য দিয়ে সহায়তা না করলে নিখোঁজ বা হিজরতে থাকা তরুণদের খুঁজে বের করা খুবই কঠিন কাজ।

সিলেট ও কুমিল্লার বাইরে হিজরতের নামে ঘরছাড়া তরুণদের মধ্যে যেসব নাম পাওয়া গেছে, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন পটুয়াখালী সদর থানার লাউকাঠি গ্রামের আল আমিন (২২), মো. মিরাজ (২৫), ইব্রাহীম (১৯), রাঙ্গাবালী থানার আন্ডার চরের মো. সাবিথ (১৯) ও কুয়াকাটার দোবাসীপাড়ার মো. হোসাইন (২২), গোপালগঞ্জের রোমান শিকদার (২৩), পুরান ঢাকার সূত্রাপুরের রাকীব হাসনাত (২৮) এবং নারায়ণগঞ্জের সানারপাড়ার বাসিন্দা জাহেদ চৌধুরী ওরফে জামিল (২৪)।

তাঁদের মধ্যে মিরাজ ঢাকা কলেজ থেকে স্নাতকোত্তর পাস করেছেন বলে জানিয়েছেন তাঁর ভাই মো. মিলন। লাউকাঠিতে ব্যবসা করেন মিলন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাবলিগ জামাতে তিন চিল্লায় (এক চিল্লায় ৪০ দিন) যাওয়ার কথা বলে গত ১৬ জুলাই বাড়ি থেকে বের হন। এরপর থেকে তাঁর ফোন বন্ধ রয়েছে। সর্বশেষ গত মাসে তাঁর মামির সঙ্গে ইমো অ্যাপে কথা বলেছিলেন মিরাজ।

পটুয়াখালী পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র আল-আমিন বাড়ি থেকে বের হন গত জুনের তৃতীয় সপ্তাহে। এখন কোথায় আছেন, জানে না তাঁর পরিবার। তাঁর বাবা ফোরকান ফকির প্রথম আলোকে বলেন, ‘আল-আমিন বাড়ি ছাড়ার আগে নিজের মুঠোফোন বিক্রি করে দেয়। গত কোরবানি ঈদের আগে (১০ জুলাইয়ের আগে) ইমো অ্যাপে তার মাকে ফোন দেয়। সে বলে, “আমি তাবলিগ করব। ঢাকায় আছি।” কিন্তু কোথায় আছে, ঠিকানা বলে না। যে ইমো থেকে ফোন করেছে, সেটা আরবি লেখা আইডি। কোনো নম্বর ওঠে না।’ ফোরকান ফকির গত শুক্রবার জানান, ‘আল-আমিন সর্বশেষ এক সপ্তাহ আগে বোনকে ইমোতে ফোন করে বলেছিল, “তুই এসএসসি পরীক্ষা ভালোভাবে দে। পরীক্ষা শেষ হলে আবার ফোন দেব। পাস করার পর তুই মাদ্রাসায় ভর্তি হবি। কলেজে না।”’

একই এলাকার বাসিন্দা ইব্রাহীম এসএসসি পাস করার পর কুয়াকাটার একটি মাদ্রাসায় কারিয়ানা পড়তেন। তাঁরা বাবা মো. নুরুজ্জামান জানান, ‘ইব্রাহীম বাড়ি ছাড়ার ৮-১০ দিন পর বাড়িতে ফোন করে জানায়, সে একজনের সঙ্গে ঢাকায় গেছে। সেখানে মাদ্রাসায় ভর্তি হবে। আমি বলি, তুই বাড়ি আয়, আমি তোকে নিয়ে ভর্তি করিয়ে দেব। এরপর যোগাযোগ বন্ধ।’

আল–আমিন, ইব্রাহীম ও মিরাজ আগে একসঙ্গে তাবলিগে গেছেন। আল–আমিন তিন মাস আগে এবং বাকি দুজন দুই মাস আগে বাড়ি ছাড়েন। তাঁদের মধ্যে যোগসাজশ আছে কি না, নিশ্চিত নয় পরিবারগুলো।

আবার কুমিল্লার নিখোঁজ তরুণদের বিষয়ে খোঁজ শুরুর পর থেকে নিখোঁজ রয়েছেন ভোলার কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তা মো. নেছার উদ্দিন। তাঁর বাড়িও ওই তিন তরুণের এলাকায়। ইব্রাহীমের বাবা নুরুজ্জামান বলেন, নেছারকে এলাকার ছেলে ও তাবলিগের কারণে ইব্রাহীম চিনতেন।

তবে তদন্তসংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানায়, গোয়েন্দা তথ্যানুযায়ী, হিজরতে বের হওয়া তরুণদের কয়েকজনকে উদ্বুদ্ধ করেছেন নেছার উদ্দিন।

নেছারের স্ত্রী সোনিয়া বেগম প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁর স্বামী এখন কোথায়, তাঁরা জানেন না। তিনি ভোলায় কর্মস্থলে থাকতেন। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে পটুয়াখালী গ্রামের বাড়ি আসতেন।

পটুয়াখালীর আন্ডার চরের সাবিথের বাবা হাসান মীর প্রথম আলোকে জানান, সাবিথ মাস দুয়েক আগে বাড়ি ছাড়ে। এরপর ফোন করে বাড়িতে জানায়, সে ঢাকার মোহাম্মদপুরে আল-আমিনের ইলেকট্রিক দোকানে চাকরি করে, থাকে শ্যামলীতে। কিন্তু বাসার ঠিকানা দিতে রাজি হয়নি। হাসান মীর বলেন, সাবিথ মাঝেমধ্যে ফোন দিত। ১৬ সেপ্টেম্বর সর্বশেষ বড় বোনকে ফোন করেছিল। এরপর আর কোনো যোগাযোগ নেই।

কুয়াকাটার দোবাসীপাড়ার মো. হোসাইন বাড়ি ছাড়েন মাস দেড়েক আগে। তাঁর বাবা হারুনুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, যাওয়ার কাউকে কিছু বলে যায়নি হোসাইন। পরে একবার ফোন করে জানায় ঢাকায় আছে, কিন্তু ঠিকানা বলেনি। তিনি জানান, লাউকাঠির নিখোঁজ ইব্রাহীমকে চেনেন। ইব্রাহীম সেখানকার মাদ্রাসায় পড়ার সময় ওই গ্রামের লজিং ছিলেন। তবে হোসাইন বেশি ঘনিষ্ঠ ছিলেন পুরান ঢাকার বাসিন্দা রাকীব হাসনাতের সঙ্গে। রাকীবও কিছুদিন কুয়াকাটার ওই মাদ্রাসায় পড়েছিলেন। হোসাইনদের এলাকায় এক বাড়িতে লজিং থাকতেন। রাকীবের সঙ্গে হোসাইন ইতিপূর্বে ঢাকায় বেড়াতেও এসেছিলেন।

তবে রাকীবের মা রাশিদা হাসনাত প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ছেলের সঙ্গে হোসাইন নামে কেউ কখনো তাঁদের বাসায় বেড়াতে আসেনি। রাকীব কোথায়, তা–ও তিনি জানেন না। তিনি বলেন, রাকীবের নির্দিষ্ট কোনো পেশা নেই। প্রায়ই সাত–আট মাস কোথাও চলে যেত, খোঁজখবর থাকত না। দেড় মাস ধরে রাকীবের খোঁজ নেই।

নারায়ণগঞ্জের জাহেদ চৌধুরী ওরফে জামিলের সানারপাড়ায় দরজি দোকান ছিল। দুই মাস ধরে তাঁর খোঁজ নেই। মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে তাঁর ভাই মো. মাসুদ গত বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, বাড়ির সবাই জানে জামিল তাবলিগে গেছে। এর বেশি কিছু তাঁরা জানেন না। তবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, কুমিল্লার যে সাত তরুণ নিখোঁজ, জামিলও তাঁদের সঙ্গে একই পথে গেছেন। কুমিল্লার নিখোঁজ তরুণদের বিষয়ে খোঁজখবর শুরুর পর সেখানকার মসজিদে কোবার ইমাম (ওয়াক্তি নামাজ) শাহ মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহকে আর পাওয়া যাচ্ছে না। র‍্যাব বলছে, এই হাবিবুল্লাহ অনেক তরুণকে উগ্র মতাদর্শে উদ্বুদ্ধ করেছেন, যাঁদের বয়স ১৭ থেকে ২২ বছরের মধ্যে।

এভাবে বিপুলসংখ্যক তরুণের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঘরছাড়ার ঘটনাকে উদ্বেগজনক মনে করছেন র‌্যাবের গণমাধ্যম ও আইন শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। তিনি বলেন, ‘হোলি আর্টিজানে হামলাকারীরা সবাই এভাবে ঘর ছেড়েছিল। এখন আবার বেশ জোরেশোরে হিজরতে বের হচ্ছে। এদের যদি খুঁজে বের করতে না পারি, এটা দুশ্চিন্তার কারণ হবে। এদের দ্বারা যেকোনো ধরনের নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ঘটে যেতে পারে।’