লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার ভেলাবাড়ী ইউনিয়নের পূর্ব শালমারা গ্রামের আনোয়ারা আক্তারের দ্বিতীয় সন্তান আরাফাতের বয়স তিন মাস। শিশুটিকে বাড়ির পাশের সরকারি টিকাকেন্দ্র থেকে এখন পর্যন্ত ছয়টি টিকা দিয়েছেন আনোয়ারা। তবে শিশুটির এখনো জন্মনিবন্ধন করানো হয়নি। আনোয়ারার বড় সন্তান তানহা আক্তারের বয়স ছয় বছর। তারও এখনো জন্মনিবন্ধন করা হয়নি। জন্মনিবন্ধন ছাড়াই তানহাকে স্কুলে ভর্তি করা হয়েছে। একই উপজেলার দুর্গাপুর ইউনিয়নের মো. আশরাফুল ইসলাম তাঁর চার মাস বয়সী সন্তান আয়ানকে টিকা দিয়েছেন। কিন্তু তারও জন্মনিবন্ধন করা হয়নি।
আনোয়ারা ও আশরাফুল প্রথম আলোকে বলেন, তাঁদের সন্তানদের যখন টিকা দেওয়া শুরু হয়, তখন জন্মনিবন্ধন করানোর কথা টিকাদানকর্মীদের কাছ থেকে তাঁরা শোনেননি। শিশুর জন্মের পর যেকোনো সময় জন্মনিবন্ধন করা যায়, এমনটাই জানেন তাঁরা। তাই তাঁরা দ্রুত জন্মনিবন্ধন করার তাগিদ বোধ করেননি।
শিশুর জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্মনিবন্ধন নিশ্চিতে টিকা কার্যক্রম শুরুর আগেই জন্মনিবন্ধন শেষ করার বিষয়ে গত বছরের ৩১ জুলাই একটি নির্দেশনা দেয় রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় (জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন)। নির্দেশনায় শিশুকে টিকা দেওয়ার সময় জন্মনিবন্ধন সনদ পরীক্ষা ও টিকা কার্ডে জন্মনিবন্ধন নম্বর লেখার কথা বলা হয়। তবে মাঠপর্যায়ে এই নির্দেশনার কার্যকর বাস্তবায়ন দেখা যায়নি বলে রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয় সূত্র জানিয়েছে।
মাঠপর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনেক টিকাদানকর্মী নির্দেশনাটি সম্পর্কে জানেন না। অনেক অভিভাবকও বিষয়টি জানেন না। এ ছাড়া নির্দেশনাটি নিয়ে প্রচারের ঘাটতি থাকার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন আইন, ২০০৪ (২০১৩ সালে সংশোধিত) এবং জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন বিধিমালা ২০১৮-এর মাধ্যমে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন করা হয়। কাজটিকে আরও গতিশীল করার লক্ষ্যে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন নির্দেশিকা ২০২১ প্রণয়ন করা হয়। আইন অনুযায়ী, জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন সবার জন্য বাধ্যতামূলক। জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্মনিবন্ধন এবং মৃত্যুর ৪৫ দিনের মধ্যে মৃত্যুনিবন্ধন করতে হয়।
অন্যদিকে শিশুর জন্মের ৬ সপ্তাহ বা ৪২ দিন পর টিকা কার্যক্রম শুরু হয়। সরকারি কর্মসূচির আওতায় যক্ষ্মার (বিসিজি) ও মুখে খাওয়ার পোলিও টিকা (ওপিভি-০) জন্মের পরই শিশুকে দেওয়া যায়। ছয় সপ্তাহ বয়সে শুরু হয় পেনটা-১ (ডিফথেরিয়া, হুপিং কাশি, টিটেনাস, হেপাটাইটিস বি, হিমোফাইলাস ইনফ্লুয়েঞ্জা বি—এই পাঁচ রোগের সম্মিলিত টিকা), পিসিভি-১ (নিউমোনিয়ার টিকা) ও ওপিভি-১ টিকা কার্যক্রম।
রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, শিশুর নাগরিক অধিকার ও আইনগত পরিচিতি নিশ্চিতে জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্মনিবন্ধন করার বিষয়টি নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই সময়সীমার মধ্যে জন্মনিবন্ধনের হার সন্তোষজনক নয়। এ বিষয়ে অভিভাবকদের মধ্যে একটা অনীহা দেখা যায়।
বাল্যবিবাহ প্রতিরোধের অন্যতম কৌশল হিসেবে শিশুর জন্মের পরপর নিবন্ধনের পরামর্শ দেন অধিকারকর্মীরা। তাঁরা বলছেন, বয়স বাড়িয়ে, ভুয়া সনদ দেখিয়ে অনেক সময় বাল্যবিবাহ হয়। বাল্যবিবাহ ঠেকানোর ক্ষেত্রে একটা উপায় হতে পারে শিশুর জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্মনিবন্ধন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, পাসপোর্ট করার সময় জন্মনিবন্ধন থাকার বাধ্যবাধকতা আছে। এই প্রয়োজনের তাগিদ যেসব অভিভাবকের আছে, তাঁরা নির্ধারিত সময়ে শিশুর জন্মনিবন্ধন করান। তেমনটা না হলে বেশির ভাগ অভিভাবক সন্তানকে স্কুলে ভর্তির সময়ই কেবল জন্মনিবন্ধন করান। আবার শহরের স্কুলে জন্মনিবন্ধন নিয়ে যতটা কড়াকড়ি আছে, গ্রামে ততটা নেই।
রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের তথ্য অনুসারে, ২০২৩ সালে জন্মের পর থেকে ৪৫ দিন বয়স পর্যন্ত জন্মনিবন্ধন হয়েছে, এমন শিশুর সংখ্যা ৯ লাখ ৭৮ হাজার ২৭৬। এর মধ্যে এক দিন বয়সী শিশুর সংখ্যা ৮ হাজার ৪৮। জন্মনিবন্ধনের এই হারকে অনেক কম বলছেন কর্মকর্তারা।
গত ২৭ ডিসেম্বর রাজধানীর কুড়িল মিয়াবাড়ী এলাকার ঢাকা নগর স্বাস্থ্য কেন্দ্র-৫-এ গিয়ে দেখা যায়, শিশুদের টিকা দিতে এসেছেন কয়েকজন মা। আলাপে তাঁরা জানান, টিকা দিলেও কোনো শিশুর জন্মনিবন্ধন করা হয়নি।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আরবান প্রাইমারি হেলথ কেয়ার সার্ভিসেস ডেলিভারি প্রকল্পের অধীনে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্র পরিচালনা করে ‘ইউনিটি থ্রু পপুলেশন সার্ভিস’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থা।
কেন্দ্রটিতে কথা হয় শাহানাজ আক্তার নামের এক মায়ের সঙ্গে। তিনি তাঁর ১ মাস ২৪ দিন বয়সী শিশু শেহতাজকে চিকিৎসক দেখাতে এসেছিলেন কেন্দ্রে। শাহানাজ প্রথম আলোকে বলেন, এই কেন্দ্রে তিনি তাঁর সন্তানকে দুবার টিকা দিয়েছেন। টিকা দেওয়ার সময় কোনোবারই কেউ জন্মনিবন্ধনের বিষয়ে তাঁকে কিছু বলেননি। কেউ সনদ দেখতেও চাননি।
একই কথা বলেন কেন্দ্রে আসা মরিয়ম আক্তার নামের আরেকজন মা। তাঁর ছেলে সাওয়াদের বয়স পাঁচ মাস। মরিয়ম বলেন, জন্মনিবন্ধন ছাড়াই সন্তানকে টিকা দিতে পেরেছেন। পরে কোনো এক সময় তিনি তাঁর সন্তানের জন্মনিবন্ধন করিয়ে নেবেন।
ডিএনসিসির এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কাউন্সিলর আসমা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, অভিভাবকেরা শিশুদের টিকা দিতে নিয়ে এলে তাঁরা তা দিয়ে কার্ড (টিকা কার্ড) করে দেন।
কেন্দ্রটির টিকাদানকর্মী ফিরোজা আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, প্রথম দিকের টিকা দিতে আনা শিশুর জন্মনিবন্ধন আছে, এমনটা খুব কমই পাওয়া যায়।
রেজিস্ট্রার জেনারেলের কার্যালয়ের নির্দেশনায় বলা হয়, জন্মনিবন্ধন শিশুর নাগরিক অধিকার ও আইনগত পরিচিতি নিশ্চিত করে। তাই সব শিশুর জন্মনিবন্ধন জন্মের পরপর হওয়া কাম্য। এ ক্ষেত্রে টিকা দেওয়ার সময় জন্মনিবন্ধন সনদ পরীক্ষা ও টিকা কার্ডে জন্মনিবন্ধন নম্বর লেখা নিবন্ধন কার্যক্রমকে ত্বরান্বিত করতে পারে। দেশের সব শিশুকে টিকা দেওয়ার আগেই যেন জন্মনিবন্ধন নিশ্চিত করা হয়, সেই লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নিবন্ধক কার্যালয়গুলোকে নির্দেশনা দেওয়া হয় চিঠিতে।
নির্দেশনার বিষয়ে জানতে চাইলে গত ২৬ ডিসেম্বর তৎকালীন রেজিস্ট্রার জেনারেল রাশেদুল হাসান প্রথম আলোকে বলেন, শিশুর জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্মনিবন্ধন করার বিধান আছে। একই বয়সে সর্বজনীন টিকাদান কার্যক্রম শুরু হয়। তাই তাঁরা শিশুর টিকাদান কার্যক্রম শুরুর সঙ্গে জন্মনিবন্ধনের বিষয়টি যুক্ত করেন। উদ্যোগ অনুযায়ী, প্রথমবার টিকা দিতে এলে শিশুর জন্মনিবন্ধন হয়েছে কি না, তা পরীক্ষা করবেন টিকাদানকর্মীরা। জন্মনিবন্ধন না হয়ে থাকলে টিকাদানকর্মীরা অভিভাবককে বলে দেবেন, পরের টিকার আগে জন্মনিবন্ধন করতে হবে। পরেরবার জন্মনিবন্ধনের নম্বর টিকা কার্ডে তুলে দেবেন টিকাদানকর্মীরা। কিন্তু তাঁদের এই উদ্যোগ কাজে আসেনি। এ ছাড়া রাজধানীর পাঁচটি সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালকে জন্মের পর নিবন্ধনের ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছিল। তবে তাঁরা সাড়া পাননি।
সে সময় রাশেদুল হাসান প্রথম আলোকে আরও বলেছিলেন, আইনি বাধ্যবাধকতা, শিশুর নাগরিক অধিকার রক্ষাসহ বাল্যবিবাহের মতো সামাজিক ব্যাধি প্রতিরোধে শিশুর জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্মনিবন্ধন হওয়াটা জরুরি। সময়মতো শিশুর জন্মনিবন্ধন বাড়াতে এখন নতুন করে ভাবতে হবে।