ঢাকা-১৭ সংসদীয় আসনে মোট ভোটার ৩ লাখ ২৫ হাজার ২০৫ জন। এর মধ্যে ২৮ হাজার ৮১৬ জনের ভোটে উপনির্বাচনে এ আসনে নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ আলী আরাফাত।
অর্থাৎ, নির্বাচনী এলাকার মাত্র ৯ শতাংশ ভোটারের সমর্থন নিয়ে রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত গুলশান, বনানী, ক্যান্টনমেন্ট নিয়ে গঠিত এ আসনের জনপ্রতিনিধি হিসেবে আরাফাত জাতীয় সংসদে বসতে যাচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এত কমসংখ্যক ভোটারের সমর্থন নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার ক্ষেত্রে আইনগত কোনো বাধা বা অসুবিধা নেই, কিন্তু বিষয়টি দৃষ্টিকটু।
সাধারণত সংসদের উপনির্বাচন নিয়ে মানুষের আগ্রহ কম থাকে। এ ছাড়া আগামী মাস চারেকের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। তাই ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন নিয়ে ভোটারদের আগ্রহ কম ছিল। এ ছাড়া ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি এ উপনির্বাচনে অংশ নেয়নি। এসব কারণে ভোট পড়ার হার কম।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ের বেশ কিছু নির্বাচনের ধারাবাহিকতায় ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচনের পর এ প্রশ্ন আবার সামনে এসেছে, আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থকেরাও কি ভোটকেন্দ্রে যাচ্ছেন না?
বিশ্লেষকেরা বলছেন, ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে জনমনে ভোটের প্রতি একধরনের অনাগ্রহ তৈরি হতে থাকে। বিভিন্ন নির্বাচনে নানা অনিয়ম-জবরদখলের ঘটনায় নির্বাচনব্যবস্থাসহ নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রতি মানুষের আস্থা নষ্ট হয়েছে। নির্বাচনব্যবস্থা অনেকটাই ভেঙে পড়েছে। ভোটের ফল নির্ধারণে ভোটারদের তেমন একটা গুরুত্ব নেই, ক্ষমতাসীনেরা যাঁকে মনোনয়ন দেবেন, তিনিই জয়ী হবেন—এমন একটি ধারণা তৈরি হয়েছে। এসব কারণে ভোটারদের বড় অংশের মধ্যে ভোট–বিমুখতা তৈরি হয়েছে।
গত সোমবার ঢাকা-১৭ আসনে উপনির্বাচন হয়। এ উপনির্বাচনে ভোট পড়ে মাত্র ১১ দশমিক ৫১ শতাংশ। এখানে আওয়ামী লীগের আরাফাতের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী আশরাফুল হোসেন ওরফে হিরো আলম।
ফলাফলে দেখা যায়, দুজনের মধ্যে ভোট পাওয়ার ক্ষেত্রে ফারাক বিস্তর। আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরাফাত পান ২৮ হাজার ৮১৬ ভোট। তাঁর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হিরো আলম পান ৫ হাজার ৬০৯ ভোট। অবশ্য এ উপনির্বাচনে পড়া মোট ভোটের ৭৭ শতাংশ পেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী।
উপনির্বাচনে ১২৪টি ভোটকেন্দ্রে ভোট গ্রহণ করা হয়। ১২৪টির মধ্যে একটি ছাড়া সব কেন্দ্রেই জয়ী হন আরাফাত। তবে কেন্দ্রভিত্তিক ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, অন্য এলাকার তুলনায় সেনানিবাস এলাকা (মানিকদী ছাড়া) ও কূটনৈতিকপাড়া হিসেবে পরিচিত বারিধারা এলাকায় এই দুই প্রার্থীর মধ্যে ভোটের ব্যবধান কম। এসব এলাকার ২৪টি ভোটকেন্দ্রের ফলাফলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী পেয়েছেন ১ হাজার ৭১৩ ভোট। হিরো আলম পেয়েছেন ৯২৭ ভোট। এসব কেন্দ্রে ভোট পড়ার হার অন্য এলাকার তুলনায় কম ছিল।
যে একটি কেন্দ্রে হিরো আলম আওয়ামী লীগের প্রার্থীর চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন, সেটিও সেনানিবাস এলাকায়। মহাখালী ডিওএইচএসে অবস্থিত বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ (পুরুষ ভোটার) কেন্দ্রে হিরো আলম পান ১১০ ভোট। আর মোহাম্মদ আলী আরাফাত পান ৭৯ ভোট।
১৯৯১ সালের পর আওয়ামী লীগ সবচেয়ে কম আসন পেয়েছিল ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে। তবে সেবারও সারা দেশের মোট ভোটারের প্রায় ৩০ শতাংশ (প্রদত্ত ভোটের ৪০ শতাংশ) পেয়েছিল আওয়ামী লীগ।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দেশের মোট ভোটারের ৪১ দশমিক ৪৭ শতাংশের সমর্থন পেয়েছিল। এর পর থেকে টানা ক্ষমতায় আছে দলটি।
ঢাকা-১৭ আসনের উপনির্বাচন ভোট পড়ার হার কম কেন, তা জানতে চাইলে গত মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘ভোট পড়ার হার কেন কম, তা আপনারাই বিশ্লেষণ করবেন। এতে আমরা আরও ভালোভাবে জানতে পারব। ইসির কোনো ত্রুটি ছিল না। টার্ন-আউট (ভোট পড়ার হার) আরও বেশি হলে ভালো হতো। তবে ইসি তো ভোট জোর করে নিতে পারে না। যেমন অস্ট্রেলিয়ায় ভোট দিতে না গেলে ৫০ ডলার জরিমানা। সেটা তো আর আমরা করতে পারি না।’
এর আগে ভোটের দিন নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা বলেছিলেন, তাঁর ধারণা, বর্তমান সংসদের মেয়াদ আর বেশি দিন না থাকায় ভোটারদের আগ্রহ কম হতে পারে। আর অভিজাত এলাকায় অনেকে হয়তো এ ভোট নিয়ে অতটা আগ্রহী না-ও হতে পারেন।
জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভোট পড়েছিল ২০০৮ সালে। নবম জাতীয় এই সংসদ নির্বাচনে ৮৭ দশমিক ৩ শতাংশ ভোট পড়েছিল। একতরফাভাবে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ ও দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বাদে অন্য সব জাতীয় নির্বাচনে ৫১ শতাংশের বেশি ভোট পড়ে।
চলতি সংসদের বিভিন্ন উপনির্বাচনে ভোটের হার কম ছিল। গত ফেব্রুয়ারিতে বিএনপির ছেড়ে দেওয়া ছয়টি আসনে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে গড়ে ভোট পড়েছিল ২৮ শতাংশের মতো। এর আগে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৩৮ শতাংশ। করোনা মহামারির মধ্যে ২০২০ সালের মার্চে ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে ইভিএমে সবচেয়ে কম ভোট পড়ার রেকর্ড রয়েছে। সেই উপনির্বাচনে ভোট পড়ার হার ছিল ৫ দশমিক ২৮।
জাতীয় সংসদের উপনির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতেও ভোট পড়ার হার আগের তুলনায় কমেছে। সবশেষ অনুষ্ঠিত গাজীপুর, খুলনা, বরিশাল, সিলেট ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট পড়েছিল ৪৬ দশমিক ৭১ থেকে ৫৮ শতাংশ। ২০১৮ সালে এই পাঁচটি সিটি নির্বাচনে ভোট পড়ার হার এর চেয়ে ৫ থেকে ২০ শতাংশ বেশি ছিল।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, এত কম জনসমর্থন নিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হওয়ার বিষয়টি লেজিটিমেসির (বৈধতা) প্রশ্ন। গণতন্ত্র হলো মানুষের সম্মতির প্রতিফলন। এ ফল সম্মতির প্রতিফলন নয়। অনেক দেশে আইন আছে, ৫০ শতাংশ ভোট না পড়লে বেশি ভোট পাওয়া প্রার্থীদের মধ্যে আবার নির্বাচন হবে। দেশে সে রকম আইন নেই। কিন্তু জনগণের সম্মতির প্রকৃত প্রতিফলন না ঘটলে গণতন্ত্র শুধু স্লোগানেই সীমাবদ্ধ থাকবে।
ভোটের হার কমার অন্যতম কারণ নির্বাচনব্যবস্থা ও নির্বাচন কমিশনের প্রতি মানুষের আস্থার অভাব বলে মনে করেন বদিউল আলম মজুমদার। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মানুষ মনে করছে, তাঁদের ভোট দেওয়া না-দেওয়াতে কিছু যায়–আসে না। যাঁর নির্বাচিত হওয়ার, তিনি বা তাঁরা নির্বাচিত হয়েই যাবেন। এটি ভয়ানক বিষয়।’