প্রাচীন গ্রিসের স্পার্টা নগরের সুন্দরী হেলেনের উপকথার সঙ্গে মিল রয়েছে চট্টগ্রামের ভেলুয়া সুন্দরীর কাহিনির। হেলেনের কাহিনিতে প্রেমকে ঘিরে হিংসা আর যুদ্ধের যে বিবরণ দেখা যায়, তেমন না হলেও ভেলুয়ার গল্পেও সেসবের দেখা মেলে। হেলেনের মতোই নিজের রূপের কারণে শেষ পর্যন্ত ট্র্যাজিক পরিণতি বরণ করে নিতে হয় ভেলুয়াকে।
গ্রিস দেশের হেলেনের বাস্তব অস্তিত্ব নিয়ে ইতিহাসবিদেরা সন্দেহ পোষণ করলেও ট্রোজান যুদ্ধ যে ঘটেছিল, সে বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। তেমনি বাস্তবে ভেলুয়া সুন্দরীর উপস্থিতি ছিল কি না, এটা জানা যায় না।
তবে ভেলুয়ার কাহিনিতে আমির সওদাগর ও ভোলা সওদাগরের মধ্যে যে যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে, তার বিবরণ আছে চট্টগ্রামের ইতিহাস রচয়িতা খান বাহাদুর হামিদুল্লাহ খাঁর তারিখ ই হামিদি নামের ফারসি গ্রন্থে। চট্টগ্রামের পাহাড়তলী রেলস্টেশনের পাশেই ভেলুয়া সুন্দরীর নামে টলটলে পরিচ্ছন্ন জলের এক বিশাল দিঘি দেখা যায় আজও।
ঘটনাচক্রে ১২ বছর বয়সী ভেলুয়ার প্রিয় কবুতরটিকে তির নিক্ষেপে হত্যা করে আমির সওদাগর। ক্ষুব্ধ ভেলুয়ার সাত ভাই তাকে বেঁধে নিয়ে আসে ভেলুয়ার কাছে। আর তখনই আমির সওদাগর ভেলুয়ার রূপে দিশা হারায়। আমিরের মনের অবস্থা কেমন, তার বিবরণ মেলে মুন্সি মোয়াজ্জম আলীর পুঁথিতে।
ভেলুয়া সুন্দরীর আখ্যান নিয়ে রচিত হয়েছে একাধিক পুঁথি। এসবের মধ্যে পালাকার মুন্সি মোয়াজ্জম আলীর লেখা ভেলুয়া সুন্দরী পুঁথি সারা দেশে জনপ্রিয় হয়েছিল। ১৯৪৫ সালে ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টার হামিদিয়া প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়েছিল এই পুঁথি। অসাধারণ ব্যঞ্জনাময় ভাষায় লেখা সেই পুঁথি একালের পাঠককেও মুগ্ধ করবে। অপরূপা ভেলুয়া দেখতে কেমন ছিল, তাঁর হৃদয়গ্রাহী বিবরণ পাওয়া যায় মুন্সি মোয়াজ্জম আলীর পুঁথিতে। ভেলুয়ার বিবরণ দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন,
‘আকাশের চন্দ্র যেন রে ভেলুয়া সুন্দরী/দূর থাকি লাগে যেন ইন্দ্রকূপের পরি/আর সুন্দর লাগে রে ভেলুয়ার চক্ষের ভঙ্গিমা/আঁখির ওপর ভুরু কন্যার অতি মনোহর/পদ্মফুলের মাঝে রে যেমন রসিক ভ্রমর।/সারি সারি দন্তগুলি যেন মুক্তার বাহার/হাসির বিজলি চটকের অতি চমৎকার।’
ভেলুয়ার সৌন্দর্যের ঝলকে অন্ধ আর দিওয়ানা হওয়া যেকোনো কঠিন হৃদয়ের পুরুষেরও নিয়তি। মহেশখালীর শাপলা নগরের মানিক সওদাগরের একমাত্র ছেলে আমির সওদাগরেরও সেই দশা হয়েছিল। আমির সওদাগর তৈলন্যা নগরের পাহাড়ে এসেছিল শিকার করতে। নদীর ধারের সেই রাজ্যের রাজা মনুহর আর ময়না সুন্দরীর একমাত্র কন্যা ভেলুয়া। ঘটনাচক্রে ১২ বছর বয়সী ভেলুয়ার প্রিয় কবুতরটিকে তির নিক্ষেপে হত্যা করে আমির সওদাগর। ক্ষুব্ধ ভেলুয়ার সাত ভাই তাকে বেঁধে নিয়ে আসে ভেলুয়ার কাছে। আর তখনই আমির সওদাগর ভেলুয়ার রূপে দিশা হারায়। আমিরের মনের অবস্থা কেমন, তার বিবরণ মেলে মুন্সি মোয়াজ্জম আলীর পুঁথিতে।
নানা ঘটনার পর অবশেষে ভেলুয়ার মন পায় আমির। বিয়েও হয় তাদের। ভেলুয়াকে নিয়ে আমির চলে যায় শাপলা নগরে। বিয়ের পর ভেলুয়াকে রেখে বাণিজ্যযাত্রায় বেরিয়ে পড়ে আমির সওদাগর।
তবে বাণিজ্যের জন্য যাত্রা করেও আমিরের পিছুটান কাটে না। অনেকটা পথ ভুল করেই তার তরি নিজের ঘাটে এসে ভেড়ে আবার। গভীর রাতে নিদ্রিত ভেলুয়ার কাছে সে যায় সবার অজান্তে। ভেলুয়া ভাবে, বুঝি স্বপ্নই দেখছে সে। স্বামী তার ফিরে এসেছে স্বপ্নের মধ্যে। প্রেমের জোয়ারে ভেলুয়াকে ভাসিয়ে তাকে আবার নিদ্রিত রেখে সওদাগর বেরিয়ে পড়ে।
পরদিন সকালে ভেলুয়ার ঘরের দরজা খোলা দেখে আমির সওদাগরের বোন ও মা ভেলুয়ার প্রতি অবিশ্বাসী হওয়ার অভিযোগ আনে। রাতের স্বপ্ন যে সত্যি ছিল, তা ভেলুয়া জানত না। প্রহেলিকায় পড়ে যায় সে। যত্নে গড়ে তোলা প্রেমের পবিত্রতা বুঝি খান খান হয়ে ভেঙে পড়ে।
নিজেকে অসতী আর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী ভাবতে শুরু করে ভেলুয়া। একদিন কলসি হাতে জল আনতে নদীতে গেলে কাট্টলীর সওদাগর ভোলার নজরে পড়ে যায় সে। আমিরের মতোই ভোলা সওদাগর প্রেমে অন্ধ হয়ে যায় প্রথম সাক্ষাতেই। নদীর ঘাট থেকে ভেলুয়াকে অপহরণ করে ভোলা নিয়ে যায় তার কাট্টলীর বাড়িতে। সেখানে সে ভেলুয়াকে বোঝায়, তার স্বামী আমির সওদাগর মারা গেছে। কোনো উপায় না দেখে ভেলুয়া ভোলা সওদাগরের কাছ থেকে ছয় মাসের সময় নেয়। তার বিশ্বাস ছিল যে এই ছয় মাসেই হয়তো স্বামী ফিরবে। স্বামীর শোকে-তাপে আর অপেক্ষায় ভেলুয়া রোগশয্যা নেয়।
এর মধ্যে শাপলা নগরে আমির ফিরে এসে ভেলুয়াকে দেখতে না পেয়ে বিবাগি হয়। দুঃখভারাক্রান্ত হৃদয়ে সে পাহাড়ে পাহাড়ে ঘুরে বেড়ায়। টোনা বারুই নামের এক বাউলের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে গানবাজনায় মনোনিবেশ করে। তবে এর মধ্যে একসময় শুনতে পায়, কাট্টলী নগরের ভোলা সওদাগরের বাড়িতেই আছে তার প্রেয়সী ভেলুয়া।
নিজেকে অসতী আর প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী ভাবতে শুরু করে ভেলুয়া। একদিন কলসি হাতে জল আনতে নদীতে গেলে কাট্টলীর সওদাগর ভোলার নজরে পড়ে যায় সে।
এরপর সৈন্যসামন্ত নিয়ে ভোলা সওদাগরের সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় আমির। রক্তক্ষয়ী সেই যুদ্ধে ভোলার মৃত্যু হয় আর আমির ফিরে পায় তার স্ত্রী ভেলুয়াকে। তবে তত দিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। রোগজর্জর ভেলুয়াকে নিয়ে শাপলা নগরে ফিরে আসে আমির সওদাগর। লোককথায় এই দৃশ্যের বিবরণ তুলে ধরতে গিয়ে কবি পদ রচনা করেছেন এভাবে—
‘বন্দরে লোকজন দেখে খাড়া হই
ঘাটে আইল চৌদ্দ ডিঙ্গা মরা কন্যা লই।’
যে আঙ্গিকেই ভেলুয়ার কাহিনি তুলে ধরা হোক না কেন, তা যেন যুগ যুগ ধরে পুরুষশাসিত সমাজে নারীর প্রবঞ্চনারই চিত্র। হেলেন থেকে শুরু করে ভেলুয়া—সব নারীর কাহিনি শেষ পর্যন্ত একই।