শুধু চা বিক্রি হবে, এমন কিছু দোকান মেলা মাঠের বিভিন্ন স্থানে থাকতে পারে। লেখক-পাঠকেরা চায়ের সঙ্গে বই নিয়ে আড্ডা দিতে পছন্দ করেন।
বইমেলায় সবাই বই কিনতেই আসেন, এমন নয়। অনেকেরই প্রধান উদ্দেশ্য একটু ঠান্ডা ঠান্ডা পরিবেশে বিকেল-সন্ধ্যা সমমনাদের সঙ্গে ঘুরেফিরে আড্ডা দিয়ে সময় কাটানো। এর ফাঁকে স্টলের সামনে দিয়ে চলতে–ফিরতে মনে ধরলে একখানা বই কেনা। তবে বই কেনার জন্যই মেলায় যান, এমনও ক্রেতা আছেন। তৌফিকুল ইসলাম তেমন একজন গ্রন্থানুরাগী।
গতকাল রোববার মেলার চতুর্থ দিনের সন্ধ্যায় তৌফিকুল গভীর মনোযোগ দিয়ে বেশ স্বাস্থ্যবান একখানা বইয়ের পাতা মেলে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছিলেন প্রথমার স্টলে। মোস্তফা কে মুজেরী, জিন্নাতুন নাদিরা ও নিয়াজ মুজেরীর লেখা এই বইয়ের নাম বাংলাদেশ: অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি ও কাঠামোগত রূপান্তর ১৯৭১-২০২১। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী পরিচালক। তবে এই চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। ইতিমধ্যে বিসিএস উত্তীর্ণ হয়েছেন। কী কী বই কিনবেন তার তালিকা নিয়ে এসেছেন। প্রথমা থেকে এই বই ও সাজ্জাদ শরিফ সম্পাদিত একাত্তরের দিনপঞ্জি বইটি কিনবেন। আরও কয়েকটি কেনার পরিকল্পনা আছে—যেমন জিয়াউদ্দিন চৌধুরীর দুই জেনারেল হত্যা, বদরুল আলম খানের ইরান: ইসলামী বিপ্লবের পূর্বাপর, জাভেদ হুসেনের মির্জা গালিবের সঙ্গে দেখা ইত্যাদি।
তবে এই বইগুলো এখনো আসেনি। কোনটি এসেছে আর কোনটি আসবে, সব খবর তাঁর জানা। অন্য প্রকাশনীর বইও কিনবেন। ইতিমধ্যে বাতিঘর থেকে কিনেছেন জাপানি ঔপন্যাসিক নীতসুমে সোসেকির উপন্যাস আই অ্যাম এ ক্যাট। জানালেন রাজধানীর সেন্ট্রাল রোডে তাঁর বাসা। অফিস থেকে ফেরার পথে প্রতি সপ্তাহেই দু-এক দিন মেলায় আসবেন বই কিনতে।
আগের প্রকাশিত বইগুলোও বিক্রি হয় নতুন বইয়ের সঙ্গে। মিরপুর থেকে মেট্রোরেলে করে এসেছিলেন একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে কর্মরত জিয়াদ বিন জাফর ও তাসফিয়া দম্পতি। তাঁরা কিনলেন মুহাম্মদ হাবিবুর রহমানের নাগরিকদের জানা ভালো।
এভাবেই কিছু কিছু করে বিক্রি বাড়ছে মেলায়। গতকাল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের অংশে প্রচুর উপস্থিতি ছিল নাগরিকদের। অনেকটা প্রায় ছুটির দিনের সন্ধ্যার মতোই। অন্বয় প্রকাশনীর প্রকাশক হুমায়ুন কবীর ঢালী বললেন, বৃষ্টির বিড়ম্বনার কারণে এবার প্রথম দিনে মেলায় লোক কিছু কম ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় দিন থেকেই যথেষ্ট সমাগম হচ্ছে। সে কারণে এবার বিক্রি ভালো হবে বলে তাঁরা আশা করছেন। তিনি বললেন, শুধু চা বিক্রি হবে, এমন কিছু দোকান মেলা মাঠের বিভিন্ন স্থানে থাকতে পারে। লেখক-পাঠকেরা চায়ের সঙ্গে বই নিয়ে আড্ডা দিতে পছন্দ করেন। অন্বয় থেকে গতকাল নুতন এসেছে কবি ফারুক মাহমুদের ছড়ার বই রঙিন ছড়া।
মেলার মাঠে ঘুরে দেখা গেল ক্রেতা-পাঠকের বসার জন্য কয়েকটি স্থানে চেয়ার পাতা হয়েছে। এবার শৌচাগারের সুব্যবস্থা ছাড়াই শুরু হয়েছিল মেলা। শৌচাগারের সংখ্যা এখনো কম। প্রথম দিন থেকেই পর্যাপ্ত সংখ্যায় ভালো শৌচাগার থাকা আবশ্যক বলে মন্তব্য করলেন প্রবাসী লেখক সিব্বির আহমদ। এবার অনন্যা থেকে তাঁর থ্রিলার হিরো সমগ্র ও নালন্দা থেকে সাইকো সিরাজ নামের নতুন উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে।
তথ্যকেন্দ্রের হিসাবে গতকাল ৬৬টি নতুন বই এসেছে মেলায়। এর মধ্যে পাঞ্জেরী এনেছে কবি মোহাম্মদ রফিকের কাব্যগ্রন্থ মরমে মরমি। বিশিষ্ট বিজ্ঞানলেখক আবদুল্লাহ আল-মুতীর আত্মজৈবনিক দুটি অপ্রকাশিত রচনা নিয়ে স্মৃতিকথা ও সাগরপারের চিঠি বইটি প্রকাশ করেছে অনুপম প্রকাশনী। জাগৃতি এনেছে অর্থনীতিবিদ সেলিম জাহানের স্মৃতিচারণামূলক বই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়: আমার মন সেথা বেড়ায় ঘুরে, কথাপ্রকাশ এনেছে যতীন সরকারের প্রবন্ধ সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রত্যাশা, বাংলা একাডেমি এনেছে কবি মুহম্মদ নূরুল হুদার প্রবন্ধ সংস্কৃতি ও সদাচার, অন্যপ্রকাশ এনেছে হাসান হাফিজের কাব্য অনন্ত ক্ষমার চিতাকাঠ, ঐতিহ্য এনেছে বেলাল চৌধুরীর গল্প সংকলন লঙ্গরখানা: দুর্ভিক্ষের গল্প সংকলন, চারুলিপি এনেছে সারওয়ার-উল-ইসলামের ছড়ার বই দুঃখিত সব যায় না বলা, অনিন্দ্য প্রকাশ এনেছে মোস্তাক আহমেদের উপন্যাস ফাগুন বসন্তে, ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ এনেছে মুবাশশিরা তাসনিম মৌমিতার অমীমাংসিত রহস্যময় ঘটনা নিয়ে ভিন্নধর্মী বই ছায়াঘর।
প্রথমা প্রকাশন এনেছে সরদার ফজলুল করিমের দিনপঞ্জিভিত্তিক নতুন বই আমার পৃথিবী: দর্শন। সমাজ। রাজনীতি
সরদার ফজলুল করিমের পৃথিবী ছিল নিরন্তর অনুসন্ধানের। বিপুল বিচিত্র জীবনাভিজ্ঞতা আর অধ্যয়নের মধ্য দিয়ে জীবন কাটিয়েছেন। তাঁর দার্শনিক মন সারাক্ষণ জীবন ও জগৎ সম্পর্কে নানা জটিল জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজে ফিরেছে। আমার পৃথিবী বইয়ে তাঁর লেখাগুলো ডায়েরি-আশ্রিত। জীবনজগৎকে কীভাবে উপলব্ধি করেছিলেন, কীভাবে গড়ে উঠেছিল তাঁর চিন্তাজগৎ, তা বুঝতে সহায়ক হবে বইটি।
সরদার ফজুলল করিমের জন্ম ১ মে ১৯২৫, বরিশালের এক কৃষক পরিবারে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৬ সালে দর্শনে স্নাতকোত্তর। এখানেই দর্শনশাস্ত্রে শিক্ষকতা শুরু। বামধারার আন্দোলন-সংগ্রামে যুক্ত হন ছাত্রজীবনেই। ১৯৫৪ সালে কারাবন্দী অবস্থায় পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে। ২০০০ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার এবং ২০১১ সালে জাতীয় অধ্যাপকের পদমর্যাদা লাভ করেন। প্রথমা থেকে প্রকাশিত তাঁর আরও বই আত্মজীবনী ও অন্যান্য, আমার প্রিয় মুখ এবং আমার জানালা।