গাজীপুরের একটি তৈরি পোশাক কারখানার কর্মী আরমিনার বয়স এখন ১৯ বছর। পাঁচ বছর আগে নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় তাঁর বিয়ে হয়। বিয়ের এক বছর পর সন্তান জন্ম দেন।
আরমিনার সন্তান এখন থাকে তাঁর মা হামিদা বেগমের কাছে। হামিদা থাকেন নীলফামারীর পঞ্চপুকুর এলাকায়। গতকাল বুধবার তাঁর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের মুঠোফোনে কথা হয়। হামিদা বলেন, তাঁর দুই মেয়ে ও দুই ছেলের মধ্যে আরমিনা দ্বিতীয়। তিনি তাঁর দুই মেয়েকেই নবম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ের এক বছর পর দুই মেয়েই সন্তানের মা হন। আর্থিক অনটনের কারণে কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। তবে মেয়েদের এত তাড়াতাড়ি সন্তান হোক, তা তিনি চাননি। আরমিনা গর্ভধারণের পর বেশ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল।
আরমিনার মতো অনেক মেয়েই কিশোর বয়সে মা হচ্ছেন। কিশোরীদের মধ্যে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী গ্রুপে মা হওয়ার অনুপাত সবচেয়ে বেশি। এই সংখ্যা হাজারে ৭০ জন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) নতুন এক জরিপ প্রতিবেদনে কিশোরীদের মা হওয়ার এই উদ্বেগজনক চিত্র উঠে এসেছে। প্রতিবেদনটির নাম ‘বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস-২০২২ ’। গত বছরের ডিসেম্বরে প্রতিবেদনটির সারসংক্ষেপ প্রকাশ করা হয়। গত ৩১ জানুয়ারি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন সংস্থার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৫ বছরের কম বয়সী কিশোরীদের মধ্যেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মা হন। এই সংখ্যা হাজারে একজনের কম (শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ)।
প্রতিবেদন অনুসারে, ১৮ বছরের আগে কিশোরীদের বিয়ের হার ২০১৮ সালে ছিল ৩০। ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ দশমিক ৯ শতাংশ। অর্থাৎ এই সময়ে কিশোরী বিয়ের হার ১০ দশমিক ৯ বেড়েছে। অন্যদিকে, ১৫ বছরের কম বয়সী কিশোরীদের বিয়ের হার ২০১৮ সালে ছিল ৪ দশমিক ৬। ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ। অর্থাৎ এই সময়ে ১৫ বছরের কম বয়সী কিশোরীদের বিয়ের হার ১ দশমিক ৯ বেড়েছে।
তবে বাল্যবিয়ের বিষয়ে সরকারের অপর একটি সংস্থার সঙ্গে বিবিএসের এই হিসাবের বড় তারতম্য লক্ষ করা গেছে। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (নিপোর্ট) বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ (বিডিএইচএস) ২০২২ অনুসারে, দেশে ১৮ বছরের কম বয়সী কিশোরীদের বিয়ের হার ৫০। ১৬ বছরের আগে প্রতি চারজন কিশোরীর মধ্যে একজনের (২৭ শতাংশ) বিয়ে হয়। ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোরীদের গর্ভধারণের হার ২৪। এখানে উল্লেখ করা সবকটি হারই আগের (২০১৭-১৮ সাল) প্রতিবেদনের চেয়ে কম।
হিসাবের এই তারতম্যের বিষয়ে বিবিএসের স্যাম্পল ভাইটাল রেজিস্ট্রেশন সিস্টেম (এসভিআরএস) ইন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম প্রকল্পের পরিচালক মো. আলমগীর হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, জরিপের পদ্ধতিগত ভিন্নতার কারণে তারতম্য হতে পারে। তা ছাড়া বিডিএইচএসের চেয়ে এসভিআরএসের জরিপে নমুনার সংখ্যা অনেক বেশি ছিল। এসভিআরএস জরিপের মাধ্যমে ৩ লাখ ৬ হাজার পরিবারে পৌঁছানো হয়। এসভিআরএসের জরিপে টিকা কার্ড বা জন্মনিবন্ধন সনদ বা স্কুলের পরীক্ষার সনদ দেখে মেয়েদের বিয়ের বয়স, গর্ভধারণের বয়স যাচাই করা হয়েছে।
বিবিএসের প্রতিবেদন অনুসারে, শহরে ১৫ থেকে ১৯ বছর বয়সী কিশোরী মায়ের সংখ্যা হাজারে ৪৪ জনের বেশি। গ্রামে তা প্রায় ৭৮ জন।
একই বয়সী গ্রুপে সবচেয়ে বেশি কিশোরী মা রাজশাহীতে। সেখানে প্রতি হাজারে ৮৭ দশমিক ৫ জন কিশোরী বয়সে মা হয়েছে। রংপুরে তা ৮৭ দশমিক ৩, খুলনায় ৮৬, চট্টগ্রামে ৭৭ দশমিক ৩, বরিশালে ৬৫ দশমিক ১, ময়মনসিংহে ৬৩ দশমিক ৬, ঢাকায় ৫৫ দশমিক ২। আর সিলেটে সবচেয়ে কম ৩৩ দশমিক ৪ জন।
স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংগঠন ওবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ফেরদৌসী বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ১৮ বছর বয়সের আগে একটি মেয়ে বিয়ের জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত হয় না। তাঁর শরীর বিয়ে ও গর্ভধারণের জন্য তৈরি হয় না। এই বয়সে গর্ভে সন্তান ধারণের মানে হলো—‘শিশুর গর্ভে শিশু’। এটা মা ও শিশু কারও জন্যই ভালো নয়। এই বয়সে মা হলে প্রসবজনিত নানা ধরনের জটিলতা দেখা দেয়। অপুষ্টি, রক্তশূন্যতা, উচ্চ রক্তচাপ দেখা দেয়। বাধাগ্রস্ত প্রসব, অপরিণত শিশু প্রসব হয়। মা ও শিশুর মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি থাকে। তা ছাড়া এই কিশোরী মায়েদের কোনো যত্নই পরিবারে হয় না।
বাল্যবিয়ে ও কিশোর বয়সে গর্ভধারণ রোধে মাঠপর্যায় থেকে প্রকৃত তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহ করে সে অনুযায়ী কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর জোর দেন ফেরদৌসী বেগম।
এসভিআরএস ইন ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম প্রকল্পের পরিচালক আলমগীর হোসেন বলেন, বাল্যবিয়ে, কিশোরী বয়সে গর্ভধারণের বিষয়টি শুধু সরকারি পদক্ষেপের মাধ্যমে রোধ করা যাবে না। সমাজের প্রত্যেকের এখানে ভূমিকা আছে। বাল্যবিয়ে ও কিশোরী বয়সে মা হওয়ার বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। তা না হলে দেশের উন্নয়নে কার্যকর অবদান রাখার মতো প্রজন্ম তৈরি করা যাবে না।