‘হাবিবুর রহমান স্মারক বক্তৃতা-১’ শীর্ষক বক্তৃতা দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম। আজ বুধবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে
‘হাবিবুর রহমান স্মারক বক্তৃতা-১’ শীর্ষক বক্তৃতা দেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম। আজ বুধবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে

জুলাই অভ্যুত্থান ইসলামি বনাম অ-ইসলামি ধরনের চিন্তাকাঠামোকে বাতিল করেছে: মোহাম্মদ আজম

জুলাই অভ্যুত্থান আগের বিভাজনের বিপরীতে এমন একটি সমন্বিত ভাষার ভিত্তিতে গড়ে উঠেছিল, যা ইসলামি বনাম অ-ইসলামি ধরনের চিন্তাকাঠামোকে পুরোপুরি বাতিল করে সামষ্টিক যৌথতার শর্ত তৈরি করেছে। এই মন্তব্য করে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মোহাম্মদ আজম বলেন, বিরোধমূলক সাংস্কৃতিক নির্মাণ এবং রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে সেই বিভেদের ওপর দাঁড় করানোই বিগত শাসনামলের প্রধান ভাবাদর্শিক অ্যাপারেটাস (হাতিয়ার) ছিল। এর বিরুদ্ধে সংঘটিত গণ–অভ্যুত্থান সেই বিরোধমূলক বিভাজনের বিপরীতে নিজের ভাষারূপ তৈরি করেছে।

আজ বুধবার বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরী মিলনায়তনে ‘হাবিবুর রহমান স্মারক বক্তৃতা-১’ শীর্ষক এক বক্তৃতা অনুষ্ঠানে মোহাম্মদ আজম এ কথা বলেন। রাষ্ট্রচিন্তা জার্নালের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ও রাষ্ট্রচিন্তার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হাবিবুর রহমানের স্মরণে এই অনুষ্ঠানে ‘ইসলাম প্রশ্ন ও বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মূলধারা: শিক্ষার্থী–জনতার অভ্যুত্থান ২০২৪–এর নিরিখে আলাপ’ শীর্ষক একক বক্তৃতা দেন মোহাম্মদ আজম। বক্তৃতার আগে প্রয়াত হাবিবুর রহমান এবং ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।

বক্তৃতায় বাংলাদেশে ইসলামি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ধরন, ইসলামি ও ‘সেক্যুলার’ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পারস্পরিকতা ও বিচ্ছেদ, এই বিচ্ছেদের ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট, মূলধারায় ইসলামি উপাদানের অনুপস্থিতিজনিত ক্ষতি এবং মূলধারার চর্চায় ইসলামি ভাব–ভাষার সঞ্চার ও এর উৎস প্রসঙ্গে কথা বলেন মোহাম্মদ আজম। ঔপনিবেশিক আধুনিকতাকে বাংলাদেশে ইসলামি ও অ–ইসলামি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ‘ভয়াবহ বিচ্ছেদের সবচেয়ে গুরুতর কারণ’ হিসেবে চিহ্নিত করেন তিনি। অধ্যাপক আজম বলেন, ইসলামি জ্ঞান, সৃজনশীলতা ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা যদি বিশ্লেষণ ও সংশ্লেষণমূলক কোনো কার্যকর ধারা তৈরি করতে পারে, তাহলে তা প্রত্যক্ষভাবে অধর্মীয় বা অ-ইসলামি বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায়ও ইতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র ঠিক কতটা রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাবে, এটি তার এক পূর্বশর্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আওয়ামী লীগের দেড় দশকের শাসনে ‘ইসলাম’ প্রশ্নকে রাষ্ট্রক্ষমতার দিক থেকে নানা মাত্রায় অপরায়ণ করা হয়েছে এবং কার্যত পুরোনো ‘ইসলামফোব’ বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকেই ভাবাদর্শিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন অধ্যাপক আজম। তাঁর পর্যবেক্ষণ, এর ফলে ভিন্ন মতাবলম্বীদের চর্চায় গতি ও ক্ষিপ্রতা এসেছে। প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে তাঁরা প্রকাশের কুশলী নানা কায়দা–কানুন উদ্ভাবন করেছেন এবং নিজেদের বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে প্রস্তুত করার চ্যালেঞ্জ নিয়েছেন।

জুলাই অভ্যুত্থানের সময়, ইশারা ও ভাষা পাঠ করা জরুরি বলে মন্তব্য করেন মোহাম্মদ আজম। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে মনে হতে পারে, শেখ হাসিনার অন্তত ১১ বছরের দমনমূলক স্বৈরশাসনের বিপরীতে জনমানুষ এতটাই মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিল যে আন্দোলনের ইশারা পেয়েই জানকবুল লড়াইয়ে রাস্তায় নেমেছে। কথাটা কেবল প্রাথমিকভাবেই সত্য। এর কয়েক মাস আগেও আওয়ামী সরকারের বিরুদ্ধে পার্টি-লাইনে আন্দোলন হয়েছিল। তাতে পার্টিগুলোর ব্যাপক জনসমর্থন দেখা গিয়েছিল। কিন্তু আন্দোলনের আহ্বান ও লক্ষ্য যে ধরনের সর্বজনীনতা লাভ করলে তা গণ–অভ্যুত্থানে পরিণত হতে পারে, তার সামান্যতম লক্ষণও দেখা যায়নি।

দলীয় পরিচয়ে নয়, বরং নবগঠিত এজমালি ভাষার অধীনে এবারের আন্দোলনে ‘ইসলামি’ উপাদানগুলো সক্রিয় ছিল বলে উল্লেখ করেন মোহাম্মদ আজম। তিনি বলেন, আন্দোলনের সমন্বয়ক এবং পরবর্তী ধাপগুলোয় যাঁরা কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেছিলেন, তাঁদের পুরোনো রাজনৈতিক ভাষায় কিছুতেই আঁটিয়ে ফেলা যায় না। ‘বৈষম্যহীন’ শব্দটির মধ্যে যে নতুন বাংলাদেশের ইশতেহার ঘোষিত হয়েছিল, আন্দোলনকারীদের প্রতিটি বয়ানে সেই নতুনত্ব ও উচ্চাভিলাষের লক্ষণ প্রকাশিত হয়েছে। শিক্ষার্থী-জনতার জুলাই অভ্যুত্থান পূর্বতন বিচ্ছেদের বিপরীতে এমন এক এজমালি ভাষার বুনিয়াদে গড়ে উঠেছিল, যা ‘ইসলামি বনাম অ-ইসলামি’ ধরনের চিন্তাকাঠামোকে সম্পূর্ণ বাতিল করে সামষ্টিক যৌথতার শর্ত তৈরি করেছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক খ আলী আর রাজী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। আরও বক্তব্য দেন অধিকারকর্মী রাখাল রাহা এবং প্রয়াত হাবিবুর রহমানের ছেলে অনিন্দ্য রহমান।