ছবি: সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট থেকে
ছবি: সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের ওয়েবসাইট থেকে

বিএনপি নেতার বাধার অভিযোগ

দরপত্র শিডিউল বিক্রি হয় ১৮৪টি, জমা পড়েছে মাত্র ৬টি

চট্টগ্রামে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের সংগ্রহ ও সংরক্ষণ বিভাগ ৫ হাজার মেট্রিক টন স্ক্র্যাপ (লোহার) নিলামে দরপত্র আহ্বান করে। দরপত্র শিডিউল বিক্রি হয় ১৮৪টি। কিন্তু বিপরীতে গত সোমবার নগরের মনসুরাবাদের সওজের (সংগ্রহ ও সংরক্ষণ) কার্যালয়ে জমা পড়েছে মাত্র ৬টি।

দরপত্র জমা দিতে এসে একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি লোকজনের ভিড় ও বাধা পেয়ে ভয়ে সরে যান বলে ডবলমুরিং থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়েছে। আরেকটি প্রতিষ্ঠানের মালিক দরপত্র জমার সময় বাধার লিখিত অভিযোগ করেছেন সওজ কার্যালয়ে।

নগর বিএনপির এক যুগ্ম সচিব ও তাঁর অনুসারীদের বাধা ও হুমকির কারণে অনেক ঠিকাদার দরপত্র জমা দেননি বলে পুলিশ, ঠিকাদার ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।

সওজ সূত্র জানায়, কর্ণফুলী নদীতে ঝুলন্ত সেতু নির্মাণের পর এরশাদ সরকারের আমলে নির্মিত লোহা ও কাঠের সেতুটি ভাঙা হয়। সেটির প্রায় ৮ হাজার টন লোহা, পাইপসহ বিভিন্ন মালামাল  সওজের স্টকইয়ার্ডে প্রায় ১৪ বছর বছর ধরে মজুত রয়েছে। গত ২৪ নভেম্বর ৫ হাজার মেট্রিক টন স্ক্র্যাপের নিলাম দরপত্র আহ্বান করা হয়। এর বিপরীতে ১৮৪টি দরপত্র শিডিউল বিক্রি হয়। কিন্তু জমার শেষ দিন সোমবার মনসুরাবাদ কার্যালয়ে দরপত্র জমা পড়েছে মাত্র ৬টি।

ফলে প্রতিযোগিতা না হওয়ায় ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠান ৫ হাজার টন স্ক্র্যাপ নিলামে পাওয়ার জন্য প্রাথমিকভাবে উত্তীর্ণ হয় ১৯ কোটি ৮০ লাখ টাকায়। তবে ওই প্রতিষ্ঠানের চেয়ে বেশি দর দিয়েও দরপত্র জমা দিতে পারেননি বলে অভিযোগ করেছেন মেসার্স ফারজানা ট্রেডিং নামে একটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী মো. সেলিম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ৫ হাজার টনের জন্য তিনি ২৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা হিসাব করে ব্যাংকে ১০ শতাংশ হারে পে-অর্ডার করেন ২ কোটি ৩০ লাখ ৩০ হাজার টাকার। কিন্তু জমা দিতে গিয়ে বাধার মুখে ফিরে আসেন। তবে কারা বাধা দিয়েছে, সে বিষয়ে কিছু বলতে রাজি হননি সেলিম।

একইভাবে এস এল স্টিলের স্বত্বাধিকারী মো. সোলায়মান সওজের নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে লিখিত অভিযোগ করেন। এতে বলা হয়, নিলামে অংশ নেওয়ার জন্য দরপত্র কেনা হলেও বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার কারণে জমা দিতে পারেননি।

ওয়েস্টিং ট্রেডিং নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, দরপত্র জমা দিতে গিয়ে বাধার মুখে ফিরে এসেছেন। কারা বাধা দিয়েছে, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি ব্যবসায়ী মানুষ। ঝামেলায় যেতে চাই না। কারা দিয়েছে, সবাই জানে।’

দরপত্র শিডিউল কেনা ঢাকার একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি পরিচয়ে মো. কবির নামের এক ব্যক্তি ডবলমুরিং থানায় করা জিডিতে উল্লেখ করেন, ‘গত সোমবার তাঁরা দরপত্র জমা দিতে যান। কিন্তু সেখানে লোকজনের ভিড় ও বাধা পেয়ে ভয়ে সরে যান। পরে তাঁদের পূর্বপরিচিত মো. ছোটন নামের এক ব্যক্তিকে দরপত্র জমা দেওয়ার কথা বলে সব কাগজপত্র নিয়ে যান। কিন্তু বিকেলে দরপত্র বাক্স খোলা হলে জানতে পারেন, তাঁদের দরপত্র জমা দেওয়া হয়নি। ছোটনকে তাঁরা ২০ হাজার টাকাও দেন। কিন্তু এর পর থেকে খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না।’

জানতে চাইলে জিডির তদন্তকারী কর্মকর্তা ডবলমুরিং থানার এসআই আবু সাঈদ গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ছোটন দরপত্র জমাদানকারী ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধির সঙ্গে প্রতারণা করেছেন। তাঁকে পাওয়া গেছে কি না, প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ঘটনার পর ফোনে কবিরের সঙ্গে ছোটনের কয়েকবার কথা হয়েছে। তাকে খুঁজে বের করা হচ্ছে।’

দরপত্র জমা দিতে এসে ফেরত যাওয়া ব্যবসায়ী ও স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নগর বিএনপির যুগ্ম সচিব শওকত আজম খাজার অনুসারীরা সরকারি এই নিলাম নিয়ন্ত্রণ করেছেন। সওজের (সংগ্রহ ও সংরক্ষণ) মনসুরাবাদ কার্যালয়ের সামনে সকাল থেকেই শতাধিক অনুসারী নিয়ে অবস্থান করেন। মনসুরাবাদের সওজ কার্যালয়ের আশপাশে মহড়া দিতে থাকেন।

সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী (সংগ্রহ ও সংরক্ষণ) শুভ্র দাশ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এস এল স্টিল নামে একটি প্রতিষ্ঠান লিখিত অভিযোগ দিয়েছে। বিষয়টি আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। আমরা চাইব সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায় করতে। যে বিডার (দরদাতা) আমাকে বেশি দর দেবে, আমি তার দলে। দ্বিতীয় দফায় আবার কল হতে পারে।’

দরপত্র জমা দিতে না পারা ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, ওই সময় সেখানে পুলিশ থাকলেও বিএনপির এই নেতার কারণে কিছু করতে পারেননি। জানতে চাইলে ডবলমুরিং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রফিক আহমেদ বলেন, ‘দরপত্র জমার দিন কেউ অভিযোগ করেননি। তবে দরপত্র জমা দিতে আসা একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি নিখোঁজের বিষয়ে আমরা তদন্ত করছি।’

যুগ্ম সচিব শওকত আজম খাজা বিএনপির রাজনীতিতে নগর বিএনপির সদস্যসচিব নাজিমুর রহমানের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। জানতে চাইলে শওকত আজম খাজা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ব্যক্তিগত অফিসের সামনে সওজ কার্যালয়। যার কারণে সব দোষ আমার ঘাড়ে চাপানো হচ্ছে। কাউকে দরপত্র জমা দিতে বাধা দেওয়া হয়নি। এলাকা হিসেবে আমার কিছু ছেলেপুলে ছিল। তারা কাউকে কিছু করেনি। মূলত দরপত্রের কিছু শর্তের কারণে সবাই অংশ নিতে পারেনি। পুনরায় দরপত্রের জন্য অপপ্রচার চালাচ্ছে কেউ কেউ।’

দলের যুগ্ম সচিব শওকত আজম খাজার বিষয়ে জানতে চাইলে নগর বিএনপির সদস্যসচিব নাজিমুর রহমান বলেন, এগুলো তেমন কিছু নয়। সব অপপ্রচার।

এদিকে ৪ ডিসেম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান নগরের ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে চট্টগ্রাম বিভাগের ১০ সাংগঠনিক জেলার বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতা–কর্মীদের রাষ্ট্রকাঠামো মেরামতের ৩১ দফার ওপর প্রশিক্ষণ কর্মশালায় প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চ্যুয়ালি যুক্ত হয়ে হুঁশিয়ারি দেন। ওই সময় তিনি বলেন, ‘৫ আগস্টের পর আমাদের কিছু সহকর্মীর মনে কিছু অদ্ভুত অনুভূতি জন্মেছে। সেটি হলো, আপনাদের আচরণে মনে হচ্ছে, আমরা সরকার গঠন করেছি। বাস্তবে কিন্তু আমরা সরকার গঠন করিনি; আমরা এখনো বিরোধী দলে। বর্তমানে ক্ষমতায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আমাদের যেসব সহকর্মীর ভুল উপলব্ধি ও বিভিন্ন আচরণের কারণে দলের ইমেজ ক্ষুণ্ন হচ্ছে, তাদের প্রতি আমার কঠোর নির্দেশনা হলো—কোনো উচ্ছৃঙ্খলতা মেনে নেওয়া হবে না।’