চট্টগ্রাম নগরের নন্দনকানন ১ নম্ব্র গলি এলাকায় মশার ওষুধ ছিটাচ্ছেন সিটি করপোরেশনের লোকজন। গতকাল বিকেল ৫টায়
চট্টগ্রাম নগরের নন্দনকানন ১ নম্ব্র গলি এলাকায় মশার ওষুধ ছিটাচ্ছেন সিটি করপোরেশনের লোকজন। গতকাল বিকেল ৫টায়

বাড়ছে ডেঙ্গু রোগী, মশা নিধনের সুফল নেই 

প্রথম ৬ মাসে আক্রান্ত ১৯৮ জন। ১ জুলাই থেকে ১২ সেপ্টেম্বরে রোগী ভর্তি হয়েছেন ৫৬৬ জন। চলতি বছরে মৃত্যু ১০ জনের। 

চট্টগ্রাম নগরে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেড়ে চলছে। এখন এডিস মশার প্রজননের মূল মৌসুম হওয়ায় মানুষের আতঙ্কও বাড়ছে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন মশা নিধন ও নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিলেও এর পুরোপুরি সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী। মশার উপদ্রবে অতিষ্ঠ নগরের অনেক এলাকার বাসিন্দারা। অনেকের মধ্যে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার শঙ্কা কাজ করছে। 

ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ও মৃত ব্যক্তিদের হালনাগাদ তথ্য সংরক্ষণ করে চট্টগ্রাম জেলা সিভিল সার্জনের কার্যালয়। তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি বছরের ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৭৬৪। মারা গেছেন ১০ জন। এর মধ্যে প্রথম ৬ মাসে (১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন) আক্রান্ত হয়েছিলেন ১৯৮ জন, মারা গিয়েছিলেন ৩ জন। ১ জুলাই থেকে ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন ৫৬৬ জন। এর মধ্যে সেপ্টেম্বরের প্রথম ১২ দিনে আক্রান্ত হয়েছেন ১৬৬ জন এবং মারা গেছেন ৪ জন। 

সার্বিকভাবে গত বছরের চেয়ে এবার আক্রান্তের হার তুলনামূলক কম। তবে সামনের দিনে কী হবে, তা নিয়ে শঙ্কা পুরোপুরি দূর হচ্ছে না। কেননা, ২০২২ সালে সেপ্টেম্বর থেকে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। ওই বছরের প্রথম ৮ মাসে (জানুয়ারি থেকে আগস্ট) আক্রান্তের সংখ্যা ছিল মাত্র ৪২৮। 

এই আট মাসে কারও মৃত্যু হয়নি। কিন্তু সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বরে—শেষ চার মাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৫ হাজার ১৭ জন এবং মারা যান ৪১ জন। এর মধ্যে শুধু অক্টোবর ও নভেম্বরে যথাক্রমে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১ হাজার ৮৬১ ও ২ হাজার ৭ জন। 

কীটতত্ত্ববিদ ও মহামারি-বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্ষা মৌসুমে সাধারণত ডেঙ্গু বাড়ে, পরে তা কমে আসে। তবে এখন বর্ষার যে ধরন, তাতে মৌসুমের পরে অর্থাৎ সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে বেশি বৃষ্টি হয়। আবার বর্ষা-উত্তর চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশে ডেঙ্গু বিস্তারের উদাহরণও আছে। তাই নিশ্চিন্ত থাকার কিছু নেই। প্রয়োজনীয় কিছু ব্যবস্থা না নিলে ডেঙ্গুর সংক্রমণ আবারও বাড়তে পারে। কারণ, বর্ষার মূল মৌসুমের পর ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়ে যাওয়ার নজির আছে। 

অবশ্য সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে না যায়, সে জন্য তাঁরা সক্রিয় আছেন। মশা নিধনের জন্য একাধিক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছেন। এ ছাড়া প্রাকৃতিকভাবে এবার সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। অন্যান্য বছর বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই থেমে থেমে বৃষ্টি হতো। এতে পানি জমে থাকত। মশা প্রজননের অনুকূল পরিবেশ ছিল। এবার এ রকম বৃষ্টি হয়নি। যখনই হয়েছে, তখন টানা ও ভারী বর্ষণ হয়েছে। ফলে পানি থাকার সুযোগ কম। এরপরও নিয়মিত ওষুধ ছিটিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। 

তবে শুলকবহর, হামজারবাগ, মোহাম্মদপুর, চান্দগাঁও, মুরাদপুর, বহদ্দারহাট, খাজা সড়ক, চকবাজার বাকলিয়া এলাকার মানুষের অভিযোগ, সন্ধ্যার পর তাঁদের এলাকায় মশার উপদ্রব বেড়ে যায়। দরজা-জানালা বন্ধ রেখেও মশার যন্ত্রণা থেকে রেহাই পাওয়া যায় না। সিটি করপোরেশনকে আরও সক্রিয় হতে হবে। 

মশা নিধনের সুফল নেই

ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে একগুচ্ছ পদক্ষেপ নিয়েছে বলে জানান সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা বিভাগের কর্মকর্তারা। এর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রাম নগরের যেসব এলাকায় টায়ারের স্তূপ রয়েছে, সেসব স্থান চিহ্নিত করে বিশেষ অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। স্থানগুলো হচ্ছে বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল, পোস্তারপাড়, দেওয়ানহাট ও সরাইপাড়া। রেড ক্রিসেন্ট ও আরবান স্বেচ্ছাসেবীদের যৌথ দলের মাধ্যমে ৪১টি ওয়ার্ডের প্রতিটিতে প্রচারপত্র বিতরণ এবং সচেতনতামূলক প্রচারণা চালানো হচ্ছে। ড্রোন ব্যবহার করে বাসাবাড়ি ও অফিস কার্যালয়ের ছাদ, ছাদবাগান ও পরিত্যক্ত জায়গা পর্যবেক্ষণ করে এডিস মশার প্রজননক্ষেত্র চিহ্নিত করা হয়েছে। যেখানে পানি জমে আছে ও লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে, সেখানেই জরিমানা করা হচ্ছে। 

ডেঙ্গু ও মশাবাহিত রোগ প্রতিরোধে বিশেষ ক্র্যাশ কর্মসূচি চলমান। কর্মসূচির আওতায় ছয় মাসের জন্য পূর্ণাঙ্গ মশা ও লার্ভা নিধনের জন্য পর্যাপ্ত ওষুধ সংগ্রহ করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা দলের সুপারিশে মসকুবান নামের ভেষজ ওষুধ ব্যবহার করা হচ্ছে। 

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ম্যালেরিয়া ও মশা নিধন কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এবার প্রাকৃতিক কারণে মশার উপদ্রব কম। ফলে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবও কমেছে। কিন্তু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করা গেছে, তা বলা যাবে না। আর এখনো শঙ্কা দূর হয়নি। কেননা, ২০২২ সালে অক্টোবর-নভেম্বরে অনেক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাই এই ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছেন তাঁরা। কার্যকর ওষুধও ছিটানো হচ্ছে। মশার ওষুধ ছিটাতে ২৫০ জনের জায়গায় এখন ৪০০ জন কাজ করছেন। সামনে যাতে ডেঙ্গুর বিস্তার বাড়তে না পারে, সে জন্য সতর্ক আছেন।

সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তা আশার বাণী শোনালেও ভিন্ন কথা বলছেন নগরবাসী। চট্টগ্রাম নগরের হামজারবাগের বাসিন্দা গৃহিণী তন্বী পাল বলেন, মশার উপদ্রবে সাত মাসের শিশু সন্তানকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় আছেন। মশার যন্ত্রণায় বাসায় থাকা দায় হয়ে পড়েছে। মশারি টানাচ্ছেন ও স্প্রে করছেন, কিন্তু মশা দূর হচ্ছে না।