ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন

দুটি ধারা বাতিল, ৮টি সংশোধনের সুপারিশ

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর গত বছরের জুন মাসে সরকারের কাছে এই সুপারিশমালা পাঠায়।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সরকারের কাছে যে সুপারিশমালা পাঠিয়েছে, তাতে আইনটির দুটি ধারা (২১ ও ২৮) পুরোপুরি বাতিল এবং আটটি সংশোধনের কথা বলা হয়েছে। এসব ধারার বেশির ভাগ বাক্‌স্বাধীনতা ও সাংবাদিকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

আইনটি নিয়ে ২০১৯ সাল থেকে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের (ওএইচসিএইচআর) সঙ্গে সরকারের আলাপ-আলোচনা চললেও দেখা যাচ্ছে, আইনটি সংশোধনের বিষয়ে তেমন অগ্রগতি নেই। ওদিকে এই আইনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া এবং গ্রেপ্তার চলছেই।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে (ডিএসএ) প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে গত ২৯ মার্চ রমনা থানায় মামলা এবং একই মামলায় পরদিন সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে কারাগারে পাঠানো (৩ এপ্রিল জামিনে মুক্ত) হয়। গত ৩১ মার্চ জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক আইনটি অবিলম্বে স্থগিত করা ও সেটিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে এর ধারাগুলোতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার আহ্বান জানান।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের সুপারিশ পর্যালোচনা চলছে। এ নিয়ে দেশের নাগরিক সমাজের সঙ্গেও আলোচনা হচ্ছে। আলোচনার মাধ্যমে যা উঠে আসে, তার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
আনিসুল হক, আইনমন্ত্রী

বাংলাদেশে অনেকে আইনটি বাতিলের দাবি করছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত রোববার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, আইনটি কোনোমতেই বাতিল করা যায় না। এটির প্রয়োজন রয়েছে। তবে দরকার হলে এটি সংশোধন করা যেতে পারে।

আইনমন্ত্রী আইনটি অপব্যবহারের কথা একাধিকবার উল্লেখ করেছেন। যদিও তিনি আইনটি স্থগিত করা বা সংশোধনের বিষয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা ঘোষণা করেননি। আইনটি কবে নাগাদ সংশোধন করা হবে, জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তরের সুপারিশ পর্যালোচনা চলছে। এ নিয়ে দেশের নাগরিক সমাজের সঙ্গেও আলোচনা হচ্ছে। আলোচনার মাধ্যমে যা উঠে আসে, তার ভিত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পর্যালোচনা করে গত বছরের জুন মাসে সুপারিশমালা বাংলাদেশ সরকারের কাছে পেশ করে। ‘ওএইচসিএইচআর টেকনিক্যাল নোট টু দ্য গভর্নমেন্ট অব বাংলাদেশ অন রিভিউ অব দ্য ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট’ শিরোনামের সুপারিশমালার অনুলিপিতে দেখা যায়, ২০১৯ সাল থেকে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে তাদের বৈঠক ও আলোচনা চলছে। সরকার ওই সব আলোচনায় জানিয়েছে যে তারা আইনটি পর্যালোচনা করতে সংস্থাটির বিশেষজ্ঞ মত গ্রহণে প্রস্তুত।

দেশে বিরোধিতার মুখে ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকর করে সরকার। এর পর থেকে গত সাড়ে চার বছরে ভিন্নমত দমনে প্রায়ই এ আইন ব্যবহৃত হয়েছে। আইনটি সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ হয়েছে ভিন্নমতের রাজনীতিক, সাংবাদিক ও শিক্ষকদের ক্ষেত্রে। সংখ্যালঘুদের ক্ষেত্রেও এ আইনের আনুপাতিক ব্যবহার বেশি বলে অভিযোগ রয়েছে। সরকারি হালনাগাদ কোনো হিসাব প্রকাশ করা না হলেও একাধিক বেসরকারি সংস্থা বলছে, অন্তত ২ হাজার ৮০০ ব্যক্তির বিরুদ্ধে এ আইনে মামলা হয়েছে।

সংস্কার বা সংশোধনের প্রক্রিয়ায় পুরো আইনের কার্যক্রম স্থগিত করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। তবে আইনগত ও বাস্তব প্রয়োজনীয়তা থাকতে হবে।
শফিক আহমেদ, সাবেক আইনমন্ত্রী

বিবেচনার ভিত্তি

ওএইচসিএইচআরের সুপারিশমালায় আইনটি সংশোধনের সময় যা বিবেচনায় রাখা উচিত, তার একটিতে সামগ্রিক ভিত্তির কথা বলা হয়েছে। তাদের মতে, আইনটি পর্যালোচনা ও সংশোধনের সময় বিবেচনায় রাখতে হবে যে বিচার মুলতবি থাকা বা তদন্তাধীন থাকা অবস্থায় মুক্ত থাকাই যেন হয় সাধারণ নিয়ম এবং আটক রাখার বিকল্প ব্যবস্থা আইনে যেন যোগ করা হয়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে রাজধানীর শাহবাগে বিক্ষোভ

সুপারিশমালায় আরও বলা হয়, জামিন এবং জামানত যেন সাধ্যের মধ্যে থাকে; ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে প্রাক্‌-বিচারে আটক রাখা যেন প্রত্যেক ব্যক্তির ক্ষেত্রে অপরাধের মাত্রা তাঁর অবস্থার ভিত্তিতে যৌক্তিক হয়; বিচার-পূর্ব আটক যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্ত হয় এবং তা নিয়মিতভাবে পর্যালোচনার ব্যবস্থা থাকে।

প্রাসঙ্গিক মানগুলো যেন আইনে নির্দিষ্ট করা থাকে এবং ‘জননিরাপত্তার’ মতো অস্পষ্ট ও বিস্তৃত না হয়। কোনো আসামিকে আদালত জামিন নামঞ্জুর করলে তা যেন তার অনুমিত নির্দোষিতাকে প্রভাবিত না করে। আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদের (ইন্টারন্যাশনাল কভনেন্ট অন সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস বা আইসিসিপিআর) অনুচ্ছেদ ১৪(২)-এর অধীনে কিছু সময় পরপর আটক রাখার যৌক্তিকতা ও প্রয়োজনীয়তা পুনরায় পরীক্ষা করা উচিত। সম্ভাব্য বিকল্প না থাকলে অভিযুক্তদের যত দ্রুত সম্ভব বিচার করতে হবে, নতুবা মুক্তি দিতে হবে।

ওএইচসিএইচআরের সুপারিশমালায় স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়, ২০১৮ সালে জাতিসংঘ মানবাধিকার পরিষদের ‘ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ’তেও বাংলাদেশ সদস্যদেশগুলোর সুপারিশ গ্রহণ করেছে। এই সুপারিশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে এবং ডিএসএসহ মতপ্রকাশের স্বাধীনতা-সম্পর্কিত আইনগুলো আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সঙ্গে পুরোপুরি সংগতিপূর্ণ করার লক্ষ্যে পর্যালোচনা ও সংশোধনের কথা আছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যেসব ক্ষেত্রে বিশেষ উদ্বেগ রয়েছে, সে তালিকায় প্রথমেই আছে মতপ্রকাশের বিভিন্ন বৈধ রূপের অপরাধায়ন। ওএইচসিএইচআরের সুপারিশমালায় বলা হয়েছে, এই অপরাধায়নের সংজ্ঞায় অস্পষ্টতা আছে এবং তা খুবই বিস্তৃত ও এর সাজা কঠোর।

দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে যাবজ্জীবনের কারাদণ্ডের বিধানও রয়েছে এতে। বাংলাদেশ যে আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদের স্বাক্ষরকারী (২০০০ সালে), সেই সনদের ১৯(৩) অনুচ্ছেদের বাধ্যবাধকতা উল্লেখ করে ওএইচসিএইচআর বলেছে, অপরাধের কারণ সাধারণ মানুষ ও আইন প্রয়োগকারী সবার বোঝার জন্য জন্য যথেষ্ট পরিমাণে নির্দিষ্ট হতে হবে। সুনির্দিষ্ট না হলে এবং তার পরিধি বিস্তৃত করার সুযোগ থাকলে আইন প্রয়োগে স্বেচ্ছাচারিতার ঝুঁকি বাড়ে।

দুটি ধারা বাতিলের সুপারিশ

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুটি ধারা বাতিলের সুপারিশ করেছে ওএইচসিএইচআর। ধারা দুটি ২১ ও ২৮।

আইনটির ২১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা ও প্রচারণা চালান বা উহাতে মদদ প্রদান করেন’ তাহলে তিনি অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ড, বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ড, বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে সাজা হবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড, বা তিন কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।

ওএইচসিএইচআর বাংলাদেশ সরকারের কাছে পাঠানো সুপারিশমালায় বলেছে, ভাষার এত ব্যাপকতা বৈধ মতপ্রকাশকে অপরাধ বানিয়ে ফেলবে। কর্তৃত্বের প্রতি শ্রদ্ধা, রাষ্ট্রীয় পতাকা বা প্রতীক-সম্পর্কিত বিষয়ে বাক্‌স্বাধীনতাকে নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে মানবাধিকার কমিটির সাধারণ উদ্বেগের কথাও এতে উল্লেখ করা হয়।

কমিটির মতে, সব রাষ্ট্রপ্রধানসহ সর্বোচ্চ রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রয়োগকারী ও অন্যান্য সব জনব্যক্তিত্ব সমালোচনার বৈধ লক্ষ্য এবং শুধু সমালোচিত ব্যক্তির পরিচয়ের কারণে আইনে শাস্তির কঠোরতা নির্ধারণ একমাত্র ভিত্তি হতে পারে না। ঐতিহাসিক তথ্য সম্পর্কে মতামত প্রকাশের প্রশ্নে শাস্তিমূলক আইন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারকে
লঙ্ঘন করে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ধারা আইসিসিপিআরের ১৯(৩) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয় উল্লেখ করে ওএইচসিএইচআর ধারাটি বাতিলের সুপারিশ করেছে। তারা আরও বলেছে, এই ধারার অধীনে ইতিমধ্যে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়ে থাকলে তাদের দায় থেকে অব্যাহতি দিয়ে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের বিষয়টি বিবেচনা করতে পারে বাংলাদেশ সরকার।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করার বা উসকানি প্রদানের অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করান, যা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত করে, তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে সাজা হবে অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ড বা ২০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড।

ওএইচসিএইচআর বলেছে, এই ধারায় প্রয়োজনীয় স্পষ্টতা নেই। বাংলাদেশ দণ্ডবিধিতে (২৯৫ক) এই বিষয়ে যেমন স্পষ্টভাবে (ইচ্ছাকৃত এবং বিদ্বেষপূর্ণ কাজ, যা কোনো শ্রেণির ধর্ম বা ধর্মীয় বিশ্বাসকে অবমাননা করে ধর্মীয় অনুভূতিতে ক্ষুব্ধ করার উদ্দেশ্যে) বলা আছে, তা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অনুপস্থিত। দণ্ডবিধিতে একই অপরাধের সাজা দুই বছরের কারাদণ্ড বা জরিমানা, যা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অনেক বেশি। এখানেও মানবাধিকার কমিটির সাধারণ অভিমত উল্লেখ করে বলা হয় যে এটি আইসিসিপিআরের ১৯(৩) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। এটি কখন অপরাধ বলে গণ্য হবে, তা সনদটিতে বলা আছে। যার অর্থ হলো বৈষম্য, বৈরিতা বা সহিংসতায় উসকানি হয় এমন পর্যায়ে উপনীত হলেই তা হবে অপরাধ।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ নম্বর ধারা বাতিল ও এই ধারার অধীনে ইতিমধ্যে কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়ে থাকলে তাদের দায় থেকে অব্যাহতি দিয়ে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণের বিষয়টি বিবেচনা করার পরামর্শ দিয়েছে ওএইচসিএইচআর।

৮টি ধারা সংশোধনের সুপারিশ

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৮, ২৫, ২৭, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩ ধারা নিয়ে পর্যালোচনা তুলে ধরে সেগুলো সংশোধনের সুপারিশ করেছে ওএইচসিএইচআর।

আইনটির ২৫ নম্বর ধারার ‘আপত্তিকর, মিথ্যা অথবা হুমকি সৃষ্টিকারী তথ্য-উপাত্ত’ এবং ২৯ ধারার ‘মানহানিকর তথ্য’ সম্পর্কে ওএইচসিএইচআর বলেছে, অন্য অনেক দেশে এগুলো দেওয়ানি অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়।

মানবাধিকার কমিটির প্রস্তাব অনুযায়ী সত্যতার যুক্তি কিংবা জনস্বার্থের যুক্তি এসব ধারায় বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। তারা বাংলাদেশ দণ্ডবিধির সঙ্গে তুলনা দিয়ে বলেছে, দণ্ডবিধিতে জনস্বার্থের যুক্তি স্বীকার করা হয়েছে। সেখানে (ধারা ৪৯৯) এ অপরাধের সাজা দুই বছরের কারাদণ্ড অথবা জরিমানা। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাজা বেশি, তিন বছর অথবা জরিমানা। আর অপরাধের পুনরাবৃত্তির বেলায় সাজা বেড়ে হবে পাঁচ বছর অথবা জরিমানা।

ওএইচসিএইচআর বলেছে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের আলোকে মানহানিকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা অনুচিত। কারণ, এর ফলে জনস্বার্থের জন্য জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রকাশে গণমাধ্যম নিরুৎসাহিত হয়, মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি হুমকি তৈরি হয়, সাংবাদিকদের বৈধ কর্তব্য পালন বাধাগ্রস্ত হয়। মানহানির বিষয়টি দেওয়ানি আইনে নিষ্পত্তির বিধান করা উচিত। শুধু গুরুতর ক্ষেত্রে ফৌজদারি আইনের প্রয়োগ করা হলেও মনে রাখা দরকার যে মানহানির জন্য কারাদণ্ড উপযুক্ত শাস্তি নয়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সাইবার অপরাধ সংঘটন-সম্পর্কিত ২৭ নম্বর ধারা বিষয়ে ওএইচসিএইচআর বলেছে, এই ধারায় বিধিবিধান খুবই প্রশস্ত ও ব্যাপক, যা সাধারণ মানুষকে তাদের আচরণ নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে স্পষ্টভাবে বুঝতে সহায়ক হয়নি। পাশাপাশি এমন পরিভাষা (টার্মিনোলজি) ব্যবহৃত হয়েছে, যাতে সাইবার অপরাধকে সন্ত্রাসবাদ হিসেবে গণ্য করার আশঙ্কা থাকে।

‘বিদেশি কোনো রাষ্ট্রের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক’ নষ্টের কাজে ব্যবহারের লক্ষ্যে তথ্য সংগ্রহ অপরাধের ভিত্তি হিসেবে যথেষ্ট নয় বলেও অভিমত দিয়েছে ওএইচসিএইচআর। তারা বলেছে, আইসিসিপিআরের ১৫ অনুচ্ছেদের সঙ্গে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের এ-বিষয়ক বিধান সংগতিপূর্ণ নয়। তাদের সুপারিশে সন্ত্রাসবাদের সংজ্ঞায়নে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকারবিষয়ক বিশেষ র‍্যাপোর্টিয়ারের নির্ধারিত সংজ্ঞা অনুসরণের কথা বলা হয়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ নম্বর ধারায় ‘সরকারের গোপনীয়তা লঙ্ঘন’ বলতে অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের আওতাধীন কোনো অপরাধকে বোঝানো হয়েছে। এর সাজা সর্বোচ্চ ১৪ বছরের কারাদণ্ড। ওএইচসিএইচআর এই বিধানের প্রয়োগ-যোগ্যতার ব্যাপকতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তারা বলেছে, ধারাটি অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতের ক্ষেত্রে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

ওএইচসিএইচআর ধারাটি আইসিসিপিআরের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার সুপারিশ করেছে। তারা আরও বলেছে, এমন সংশোধনী আনা দরকার, যাতে সত্যতা ও জনস্বার্থের যুক্তি এবং হুইসেলব্লোয়ারের (জনস্বার্থে তথ্য ফাঁসকারী ব্যক্তি) সুরক্ষা নিশ্চিত হয়।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৮ নম্বর ধারায় কোন কোন পরিস্থিতিতে পুলিশ ও ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) তথ্য-উপাত্ত অপসারণ বা আটকানোর অনুরোধ করতে পারবে, তা উল্লেখ আছে। ওএইচসিএইচআর বলছে, ধারাটিতে দেওয়া ক্ষমতা আইসিসিপিআরের অনুমোদিত সীমার বাইরে।

ধারাটিতে অস্পষ্টতা ও অপরাধ সংজ্ঞায়নে ব্যাপকতা আছে, যার কারণে এর মাত্রাতিরিক্ত ও অনানুপাতিক প্রয়োগে বৃহৎ সংখ্যক ব্যবহারকারী অযথাই ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারেন। আবার বেআইনি বা অপরাধমূলক নয়, এমন আধেয় বা কনটেন্ট অপসারণ ও আটকানোর সুযোগও ধারাটিতে রয়েছে।

ওএইচসিএইচআর মনে করে, বিটিআরসি কোনো স্বাধীন প্রতিষ্ঠান নয়, বরং নির্বাহী সংস্থা। আইনের ভিত্তিতে আধেয় অপসারণ বা আটকানোর সিদ্ধান্তটি স্বাধীন কোনো প্রতিষ্ঠান, যা বিচারিক হওয়াই শ্রেয়, তার ওপর অর্পিত হওয়া উচিত।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৪৩ নম্বর ধারায় পুলিশকে বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি, জব্দ করা ও গ্রেপ্তারের ‘সীমাহীন ক্ষমতা’ দেওয়া হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয় ওএইচসিএইচআরের সুপারিশে। তারা বলেছে, আদালতের পূর্ব অনুমোদন ছাড়া অপরাধ তদন্তে তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের এই বিধান মানবাধিকার কমিটির সুপারিশমালার পরিপন্থী। এই ক্ষমতা আইসিসিপিআরের ১৯(৩) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই তদন্তকারী কর্মকর্তার ক্ষমতা স্পষ্টভাবে সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া দরকার।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৫৩ নম্বর ধারায় এই আইনের কোন কোন ধারার অপরাধ জামিনযোগ্য ও অজামিনযোগ্য হবে, তা বলা হয়েছে। অজামিনযোগ্য ধারার মধ্যে ২১, ২৭, ২৮, ৩১ ও ৩২ নম্বর ধারাও রয়েছে, যেগুলো সংশোধন অথবা বাতিলের সুপারিশ করেছে ওএইচসিএইচআর। অজামিনযোগ্যতা বিষয়ে তারা বলেছে, এর ফলে বিচারের জন্য অপেক্ষমাণদের কোনো প্রতিকার লাভের সুযোগ রাখা হয়নি।

বাংলাদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ বন্দী প্রাক্‌-বিচার বন্দী উল্লেখ করে তারা আরও বলেছে, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনে প্রাক্‌-বিচার বন্দিত্ব হচ্ছে ব্যতিক্রম, স্বাভাবিক নিয়ম নয়। ধারাগুলোতে আটক বিচারাধীন বন্দীদের প্রত্যেকের আলাদাভাবে আটক রাখার যৌক্তিকতা মূল্যায়ন এবং নিয়মিত বিরতিতে পুনর্মূল্যায়নের ব্যবস্থা না থাকা আইসিসিপিআরের ৯ ও ১৪ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

ওএইচসিএইচআর বিচার না হওয়া পর্যন্ত মুক্তি দেওয়াকে স্বাভাবিক নিয়ম গণ্য করা, বিকল্প হিসেবে সাধ্যানুযায়ী জামানতসাপেক্ষ জামিন, প্রাক্‌-বিচার আটকাবস্থাকে প্রত্যেকের ক্ষেত্রে আলাদাভাবে যৌক্তিকতা ও আবশ্যকতার মূল্যায়ননির্ভর ব্যতিক্রম বিবেচনা করা এবং প্রাক্‌-বিচার আটকের ক্ষেত্রে দ্রুততম সময়ে বিচার সম্পন্ন করার ব্যবস্থা নিশ্চিতে আইন সংশোধনের সুপারিশ করেছে। মূল্যায়নের ক্ষেত্রে ‘জননিরাপত্তার’ মতো অস্পষ্ট এবং বিস্তৃত মান প্রয়োগের ব্যবস্থা রাখা উচিত হবে না বলেও তারা মনে করে।

‘স্থগিতে বাধা নেই’

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অবিলম্বে স্থগিত করা ও সংশোধনের যে আহ্বান জানিয়েছেন, সে বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সংস্কার বা সংশোধনের প্রক্রিয়ায় পুরো আইনের কার্যক্রম স্থগিত করার ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। তবে আইনগত ও বাস্তব প্রয়োজনীয়তা থাকতে হবে।