মোট সহিংসতার ৫৯ শতাংশই ঘটে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি ও ধর্মীয় স্থান ধ্বংসের মাধ্যমে।
আর ১১ শতাংশ সরাসরি ভূমিকেন্দ্রিক বিরোধকে ঘিরে।
সহিংসতার মাধ্যমে ২৭ শতাংশ ক্ষেত্রে শারীরিক নিগ্রহ বা হত্যার ঘটনা ঘটে।
দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতার ৭০ ভাগই ভূমিকেন্দ্রিক। আর এ সহিংসতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে সংখ্যালঘুদের বিষয়সম্পদ বা ধর্মীয় উপাসনালয় ধ্বংসের মাধ্যমে। ২০১৩ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের ওপর বিভিন্ন সহিংসতার ধরন বিশ্লেষণ করে এ তথ্য দিয়েছে গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর অল্টারনেটিভসের (সিএ) বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরি (বিপিও)। গতকাল বুধবার এ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই সহিংসতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে এখন বড় ভূমিকা রাখছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে (মূলত ফেসবুক) ছড়ানো অপতথ্য। এসব প্ল্যাটফর্মে সংখ্যালঘুদের নিয়ে ঘৃণা ছড়ানোর ঘটনাও বাড়ছে। বিশেষ করে হিন্দু নারীরা এর ভুক্তভোগী হচ্ছেন বেশি মাত্রায়।
সহিংসতা সৃষ্টির ক্ষেত্রে এখন বড় ভূমিকা পালন করছে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়ানো অপতথ্য।
বিপিওর প্রতিবেদনে এবার বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর নিপীড়নের বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। সেখানে সহিংসতার ধরন নিয়ে বলা হয়েছে, মোট সহিংসতার ৫৯ ভাগই ঘটে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি ও ধর্মীয় স্থান ধ্বংসের মাধ্যমে। আর ১১ শতাংশ সরাসরি ভূমিকেন্দ্রিক বিরোধকে ঘিরে। দুটো মিলিয়ে ৭০ ভাগ সহিংসতাই আসলে ভূমিকেন্দ্রিক। সহিংসতার মাধ্যমে ২৭ ভাগ ক্ষেত্রে শারীরিক নিগ্রহ বা হত্যার ঘটনা ঘটে। মোট ২ শতাংশ লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা আর ১ শতাংশ নির্বাচনকেন্দ্রিক।
সেন্টার ফর অল্টারনেটিভসের নির্বাহী পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, এখন সহিংসতার উৎস হয়ে উঠছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো অপতথ্য। একে পুঁজি করছে স্থানীয় স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। মূল উদ্দেশ্য সংখ্যালঘুদের সম্পদহানি। আর এ কাজে রাজনৈতিক গোষ্ঠীর সায় দেখা যায় বেশির ভাগ স্থানে।
ভূমির অধিকারসহ সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার সুরক্ষায় রাষ্ট্রের যে ভূমিকা পালন করা দরকার, সেটা যথাযথভাবে দেখছি না। এখানে সুশীল সমাজের ভূমিকাকেও খর্ব করা হচ্ছে দিন দিন। এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার।অধ্যাপক মিজানুর রহমান, সাবেক চেয়ারম্যান, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
সহিংসতার বেশি শিকার হিন্দুরা
বিপিওর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে ৯ বছরে সংখ্যালঘুদের ওপর যত সহিংসতা হয়েছে, তার বেশির ভাগই হয়েছে হিন্দুদের ওপর। অন্য সংখ্যালঘুদের চেয়ে হিন্দুদের সংখ্যা বাংলাদেশে বেশি। আর তাঁরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে বাস করেন। এভাবে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাস তাঁদের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
ভূমি বা সম্পত্তি কেন লক্ষ্যবস্তু হয়—এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, সহিংসতা তৈরি করে সংখ্যালঘুদের মধ্যে একধরনের ভীতি সৃষ্টি করাই মূল উদ্দেশ্য। যাতে করে হিন্দুরা তাঁদের সহায়-সম্পদ বিক্রি করে দেন। নিরাপত্তাহীনতার কারণে দেশের হিন্দুদের মধ্যে ভারতে চলে যাওয়ার এক ধরনের প্রবণতা আছে।
বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার পেছনে রাজনৈতিক প্রভাবশালী চক্রের ইন্ধন থাকে। এর উদ্দেশ্য সংখ্যালঘুদের ভূমি দখলের মাধ্যমে তাঁদের দেশত্যাগে বাধ্য করা। এই তৎপরতার সঙ্গে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক আছে লুটেরা, ভূমিদস্যু ও সাম্প্রদায়িক শক্তির।
অপতথ্যের বিস্তৃতি সহিংসতা বাড়াচ্ছে
প্রতিবেদনে বলা হয়, অনলাইন প্ল্যাটফর্মে অপতথ্যের ফলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ধারাবাহিক সহিংসতার শিকার হয়ে চলেছেন। এ প্রসঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলা এবং কক্সবাজারের রামুতে বৌদ্ধদের ওপর হামলার প্রসঙ্গ উল্লেখ করা হয়।
ফেসবুকে ধর্মীয় অবমাননাকর ছবি পোস্টের অভিযোগ তুলে ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর নাসিরনগরে ১৫টি মন্দির ও তিন শতাধিক বাড়িঘরে হামলা, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাট করা হয়। এসব ঘটনায় করা আটটি মামলার মধ্যে একটি মামলায় গত বছরের (২০২৩) ৬ মার্চ ১৩ জনকে কারাদণ্ড দেন আদালত। বাকি সাতটি মামলার বিচারকাজ এখনো শেষ হয়নি।
রসরাজ দাস (৩৭) নামের এক যুবকের ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে হামলা হয় বলে অভিযোগ ওঠে। যদিও রসরাজের ফেসবুক, মুঠোফোন ও মেমোরি কার্ডে ছবির অস্তিত্বই পায়নি পিবিআই ও সিআইডির ফরেনসিক বিভাগ।
সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার পেছনে রাজনৈতিক প্রভাবশালী চক্রের ইন্ধন থাকে। এর উদ্দেশ্য সংখ্যালঘুদের ভূমি দখলের মাধ্যমে তাঁদের দেশত্যাগে বাধ্য করা। এই তৎপরতার সঙ্গে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষের কোনো সম্পর্ক নেই। সম্পর্ক আছে লুটেরা, ভূমিদস্যু ও সাম্প্রদায়িক শক্তির।বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার দীর্ঘ সময় ধরে অপতথ্য নিয়ে কাজ করছেন। তিনি অবশ্য একে ‘কুতথ্য’ বলেন। তিনি মনে করেন, ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে এই কুতথ্য নতুন কিছু নয়। ইন্টারনেট ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপক প্রসারে এর বিস্তৃতি বেড়েছে।
শান্তনু মজুমদার বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যে কাউকে, যেকোনো ধরনের কুতথ্য ছড়ানোর একটা সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। ক্রমাগত এসব ঘৃণার শিকার হয়ে সংখ্যালঘুদের অনেকেই নিজেদের ‘আত্মধিক্কার’ দেওয়ার মতো পরিস্থিতিতে পৌঁছাচ্ছেন বা অপরাধের শিকার ব্যক্তিকেই দোষারোপ করা হচ্ছে। ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু নারীদের পোশাক, চলাফেরা এসব নিয়েই এসব সাম্প্রদায়িক ঘৃণা প্রসারিত হচ্ছে।
সরকার, রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজ—এই ত্রয়ীর মিলিত কার্যকর প্রচেষ্টা সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা নিরসনে বড় ভূমিকা পালন করতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধে সংখ্যালঘু সংগঠন এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা খুব জোরালো ভূমিকা পালন করছেন না বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রতিবেদনের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভূমির অধিকারসহ সংখ্যালঘুদের মানবাধিকার সুরক্ষায় রাষ্ট্রের যে ভূমিকা পালন করা দরকার, সেটা যথাযথভাবে দেখছি না। এখানে সুশীল সমাজের ভূমিকাকেও খর্ব করা হচ্ছে দিন দিন। এ অবস্থার পরিবর্তন দরকার।’