রুবিনা আক্তারের (৪৫) লাশ যখন বাড়ির সামনে আনা হয়, তখন তাঁর স্কুলপড়ুয়া ছেলে আরাফাত রহমান (রোহান) বাসার দোতলায় ছিল। লাশবাহী গাড়ি থেকে রুবিনার এক ভাই ও দুই বোন দোতলায় যান। তারা আরাফাতকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। অন্য স্বজনেরাও হাউমাউ করে কাঁদছিলেন। তাঁরা রুবিনার নানা স্মৃতির কথা মনে করে বিলাপও করছিলেন। তবে আরাফাতের যেন এসবে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। অপলক দৃষ্টিতে সে তাকিয়ে ছিল, একটি কথাও বলেনি। তবে তার দুচোখ দিয়ে পানি ঝরছিল।
আজ শনিবার বিকেল চারটার দিকে রাজধানীর তেজগাঁওয়ের হোন্ডা গলিতে রুবিনার স্বামী প্রয়াত মাহবুবুর রহমানের বাড়ির দৃশ্য ছিল এমন। গতকাল শুক্রবার বেলা তিনটার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ব্যক্তিগত গাড়িতে চাপা পড়ে রুবিনার মৃত্যু হয়। গাড়ির ধাক্কায় মোটরসাইকেল থেকে পড়ে যান রুবিনা। সেই গাড়ির নিচে চাপা পড়লে তাঁকে এক কিলোমিটারেরও বেশি টেনে নিয়ে যান চালক। এতে তাঁর শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। রুবিনার স্বামী মাহবুবুর রহমান দুই বছর আগে মারা যান। ছেলে আরাফাত রহমান তেজগাঁওয়ের একটি স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ে। একমাত্র ছেলেকে তিনি তেজগাঁওয়ে স্বামীর বাসাতেই থাকতেন।
আজ শনিবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়নাতদন্ত শেষে রুবিনার লাশ প্রথমে নেওয়া হয় তেজগাঁওয়ের বাসায়। সেখানে ছেলে আরাফাত রহমানকে জড়িয়ে ধরে রুবিনার ভাই জাকির হোসেন কান্নায় ভেঙে পড়েন। ভাগনেকে জড়িয়ে ধরে তিনি বলেন, ‘ভাইগনারে, আমার বাবারে, তোর এখন কী হবে? বাবা তুই একলা হয়ে গেলি।
একটাই কষ্ট আমার, তোর কেউ রইল না।’ এ সময় আরাফাত রহমান কারও সঙ্গে কোনো কথা বলছিল না। প্রায় ১০ মিনিট পর আরাফাতকে নিয়ে দোতলার বাসা থেকে নিচে নেমে আসেন জাকির হোসেন। নিচে নেমেও আরাফাত কারও সঙ্গে কথা বলেনি।
তেজগাঁওয়ের বাসার সামনে প্রায় আধা ঘণ্টা লাশবাহী গাড়িতে রুবিনার লাশ রাখা হয়।
পরে সেই গাড়িতে করেই তাঁর লাশ নেওয়া হয় হাজারীবাগে বাবার বাড়িতে। সেখানে জানাজা শেষে সন্ধ্যার পর রুবিনাকে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করা হয়।
স্বজনেরা জানান, রুবিনার স্বামী মাহবুবুর রহমান একসময় ঠিকাদারি করতেন। স্বামীর মৃত্যুর পর ছেলেকে নিয়েই দুশ্চিন্তা ছিল রুবিনার। বাড়িভাড়া থেকে পাওয়া টাকা আর স্বজনদের সহযোগিতায় ছেলের পড়াশোনা চালিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি। রুবিনার বোন সুলতানা লিপি বলেন, ‘রুবিনা প্রায়ই বলত, আমি বেশি দিন বাঁচব না। মরে গেলে আমার ছেলেটাকে দেখে রাখিস।’
সুলতানা লিপি বলেন, স্বামীর মৃত্যুর পর রুবিনা একেবারে ভেঙে পড়েছিলেন। তিনি না থাকলে ছেলের কী হবে—সব সময় এই ভাবনা ছিল তাঁর। তিনি যে সত্যি চলে যাবেন, এটা কখনো ভাবতে পারেননি। তাঁর একটাই স্বপ্ন ছিল, ছেলেকে মানুষের মতো মানুষ করবেন।
রুবিনার অপ্রাপ্ত বয়সী ছেলে আরাফাত রহমান এখন কার কাছে থাকবে, এ নিয়ে স্বজনেরা বলছেন, রুবিনার ভাই ও বোনদের তত্ত্বাবধানেই থাকবে আরাফাত। রুবিনার ভাই জাকির হোসেন বলেন, ‘রুবিনার ছেলেকে আমি নিজের সন্তান মনে করি। সে আমার সন্তান হয়েই থাকবে।’
রুবিনার মৃত্যুর ঘটনায় গতকাল শুক্রবার গভীর রাতে শাহবাগ থানায় মামলা করেন তাঁর ভাই জাকির হোসেন। মামলায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক শিক্ষক আজহার জাফর শাহকে একমাত্র আসামি করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে সড়ক পরিবহন আইনে দায়ের করা মামলায় বেপরোয়া ও দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে মৃত্যু ঘটানোর অভিযোগ আনা হয়েছে।
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, মামলা দায়ের পরই চালক আজহার জাফর শাহকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। পথচারীদের মারধরে আহত হয়ে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি আছেন। পুলিশি হেফাজতেই তাঁকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
রুবিনার ভাই জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, রুবিনা গাড়ির নিচে চাপা পড়ার পর এক কিলোমিটারের বেশি টেনে নিয়ে যান চালক। পথচারীরা তাঁকে আটক না করলে তিনি আরও অনেক দূর পর্যন্ত টেনে নিয়ে যেতেন। চালক যদি শুরুতেই গাড়ি থামাতেন, তাহলে রুবিনা হয়তো মারা যেতেন না। তাঁর যেন ফাঁসি হয়। আর কোনো চালক যেন এমন বেপরোয়া গাড়ি না চালান, সেই অনুরোধ করেন তিনি।