বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপের (২০২২) চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞের তথ্য।
শিশুজন্মে অস্ত্রোপচার বাবদ দেশে প্রতিবছর ৩ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা খরচ হয়। এর মধ্যে প্রায় ২ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ব্যয় হয় অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রসবের সময় অস্ত্রোপচার মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর ব্যানবেইস মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপের (২০২২) চূড়ান্ত প্রতিবেদন উপস্থাপনের সময় দেশে শিশুজন্মে অস্ত্রোপচারে বিপুল খরচের বিষয়টি বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়। জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা প্রতিষ্ঠান (নিপোর্ট), আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) এবং যুক্তরাষ্ট্রের দাতা সংস্থা ইউএসএআইডি যৌথভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
স্বাস্থ্য খাতের গ্রহণযোগ্য তথ্য ও পরিসংখ্যানের উৎস জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ। জাতীয়ভিত্তিক এই জরিপের তথ্য নীতিনির্ধারক, গবেষক, চিকিৎসক, দাতা সংস্থা ও সাংবাদিকেরা নিয়মিত ব্যবহার করেন। ১৯৯৪ সালের পর থেকে দু–তিন বছর পরপর এই প্রতিবেদন নিয়মিত বের হচ্ছে। সর্বশেষ অর্থাৎ ২০২২ সালের জরিপের প্রাথমিক প্রতিবেদন ২০২৩ সালের এপ্রিলে প্রকাশ করা হয়েছিল। গতকাল ৫০২ পৃষ্ঠার চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। জরিপের বিভিন্ন বিষয় একাধিক গবেষক পৃথকভাবে উপস্থাপন করেন।
জন্ম ও জন্মের পেছনে ব্যয়
প্রতিবেদনের শিশুজন্মের স্থান, স্বাভাবিক প্রসব, অস্ত্রোপচারে শিশুজন্মবিষয়ক অংশটি উপস্থাপন করেন আইসিডিডিআরবির বিজ্ঞানী আহমদ এহসানূর রহমান। তিনি বলেন, দেশে বছরে ৩৬ লাখ শিশুর জন্ম হয়। এর মধ্যে ২০ লাখ প্রসব হয় স্বাভাবিক; বাকি ১৬ লাখ প্রসব হয় অস্ত্রোপচারে। অস্ত্রোপচারের ৮০ শতাংশই ঘটে বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে।
অনুষ্ঠানের স্বাভাবিক প্রসব ও অস্ত্রোপচারে গড়ে কত খরচ হয়, তার একটি হিসাব দেওয়া হয়। তাতে দেখা যায়, প্রতিটি স্বাভাবিক প্রসবে ৭ হাজার ৭৬৫ টাকা খরচ হয়। অন্যদিকে প্রতিটি অস্ত্রোপচারে খরচ হয় ২৩ হাজার ৯৪৪ টাকা।
আহমদ এহসানূর রহমান বলেন, শিশুজন্মে অস্ত্রোপচারের জন্য বছরে ৩ হাজার ৮৪৬ কোটি টাকা খরচ হয়। এর মধ্যে তিন–চতুর্থাংশ অস্ত্রোপচারের কোনো প্রয়োজনই ছিল না। অর্থাৎ ২ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকা ব্যয় হয় অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচারে। এমন অস্ত্রোপচারের ব্যয়ের ৮৭ শতাংশ হয় বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে।
মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, অস্ত্রোপচার একটি জীবনদায়ী ব্যবস্থা। গর্ভধারণ ও প্রসবে জটিলতার কারণে সর্বোচ্চ ১৫ শতাংশ প্রসবের ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার লাগতে পারে; কিন্তু এর কিছু ক্ষতিকর দিকও আছে। যেমন অস্ত্রোপচারে মায়ের শরীরে ক্ষতস্থানে সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে, অনেক সময় প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। ভবিষ্যতে মা হওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতার ঝুঁকি থাকে। অন্যদিকে নবজাতকের শ্বাস নেওয়ার ও রক্তে শর্করা কম হওয়ার ঝুঁকি থাকে।
জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপে দেখা যাচ্ছে, দেশে হাসপাতালে বা ক্লিনিকে প্রসব বাড়ছে। ২০১৭–১৮ সালের জরিপে দেখা গিয়েছিল ৩৯ শতাংশ প্রসব বাড়িতে আর ৫১ শতাংশ প্রসব হাসপাতাল বা ক্লিনিকে হয়। এখন হাসপাতাল বা ক্লিনিকে প্রসবের হার বেড়েছে। ৬৫ শতাংশ প্রসব হচ্ছে হাসপাতাল বা ক্লিনিকে। এর মধ্যে বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকে জন্ম হচ্ছে বেশি।
সিলেট পিছিয়ে
নিপোর্টের পরিচালক (গবেষণা) মোহাম্মদ আহছানুল আলম ১৫টি স্বাস্থ্য সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, দেশের ৬৪ শতাংশ দম্পতি জন্মনিয়ন্ত্রণের সামগ্রী ব্যবহার করেন। বিভাগগুলোর মধ্যে সিলেটে এই হার সবচেয়ে কম। সিলেট বিভাগের ৪৪ শতাংশ দম্পতি জন্মনিয়ন্ত্রণের সামগ্রী ব্যবহার করেন। জন্মনিয়ন্ত্রণের সামগ্রী ব্যবহারের হার সবচেয়ে বেশি রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে। এই দুটি বিভাগে ৬১ শতাংশ করে দম্পতি জন্মনিয়ন্ত্রণের সামগ্রী ব্যবহার করেন।
জরিপে দেখা যাচ্ছে, প্রসবপূর্ব সেবা চারবার পান দেশের ৪১ শতাংশ গর্ভবতী, প্রসবের সময় প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর সহায়তা পান ৭০ শতাংশ মা, ৬৫ শতাংশ প্রসব হয় হাসপাতাল বা ক্লিনিকে, অত্যাবশ্যকীয় সেবা পায় মাত্র ৩ শতাংশ নবজাতক।
অনুষ্ঠানে জ্যেষ্ঠ স্বাস্থ্যসচিব এম এ আকমল হোসেন আজাদ, ব্যানবেইসের মহাপরিচালক মো. মজিবুর রহমান, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক নাজমুল হোসেন প্রমুখ বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন নিপোর্টের মহাপরিচালক আশরাফী আহমদ।