আওয়ামী লীগের টানা ক্ষমতার তৃতীয় মেয়াদেও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভুল ও পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির কাজ শেষ হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫২ বছরেও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভুল ও পূর্ণাঙ্গ কোনো তালিকা তৈরি করা সম্ভব হয়নি। এই তালিকা তৈরির আইনগত কর্তৃত্ব জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা)।
তারা এখনো প্রায় প্রতিটি বৈঠকে (মাসে) বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নতুন কারও নাম অন্তর্ভুক্ত করছে, নয়তো আগের তালিকা থেকে কাউকে বাদ দিচ্ছে। ফলে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নির্ভুল ও পূর্ণাঙ্গ তালিকা আওয়ামী লীগের টানা ক্ষমতার তৃতীয় মেয়াদেও শেষ হবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গেজেট শাখা বলছে, বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মোট ২ লাখ ৩৫ হাজার ৪৬৭ জনের নাম বিভিন্ন সময়ে গেজেটভুক্ত হয়েছিল। অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের বাজেট শাখা বলছে, গত জানুয়ারি মাসে ২ লাখ ১৯ হাজার ৭৫৮ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার নামে ভাতা (মাসিক সম্মানী) বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আর স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ২০২১ সালের মার্চ মাসে ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৩৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধার একটি তালিকা (অপূর্ণাঙ্গ) সরকার প্রকাশ করেছিল। ফলে দেশে বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রকৃত সংখ্যা কত, তা নিয়ে অস্পষ্টতা রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলছেন, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা তৈরির কাজ প্রায় শেষের দিকে। পূর্ণাঙ্গ তালিকায় সংখ্যাটি ১ লাখ ৯০ হাজারের বেশি হবে না বলেই মনে করছেন তিনি। গত বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘আগামী জুনের পর আর কোনো আপিল আবেদন (কোনো কারণে কেউ তালিকা থেকে বাদ পড়লে) গ্রহণ করা হবে না এবং নতুন কাউকে তালিকায় যুক্ত করা হবে না। এ বছরের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকার কাজ শেষ করার বিষয়ে আমি আশাবাদী।’
জামুকা বলছে, নিজেকে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রমাণের জন্য ৩৩ ধরনের প্রমাণক (কাগজপত্র) লাগে। অনেক মুক্তিযোদ্ধার নামই একেক নথিতে একেক রকম। তবে জাতীয় পরিচয়পত্রের নামই শেষ পর্যন্ত বিবেচনায় নেওয়া হয়। অনেকের পরিচয়পত্রে দেওয়া নাম আর মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নাম এক না থাকায় নানা সমস্যা হচ্ছে। যে কারণে পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করতে সময় লাগছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম লেখাতে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দুজন মন্ত্রী ২০২১ সালে জামুকায় আবেদন করেছিলেন। জামুকা নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ‘বিশেষ বিবেচনায়’ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিমকে বীর মুক্তিযোদ্ধার ‘স্বীকৃতি’ দেয়। অন্যদিকে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল যে আবেদন জামুকার কাছে করেছিলেন, যাচাই-বাছাইয়ের পর তা বাতিল করে দেওয়া হয়। এমন অসংখ্য প্রভাবশালী ব্যক্তির আবেদন এখনো জামুকায় রয়েছে। জামুকা এসব আবেদন যাচাই-বাছাই করছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় এখনো সব প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম ওঠেনি, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে যাননি এমন অনেক লোকের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।শাহরিয়ার কবির, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি
বর্তমানে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা মাসিক ২০ হাজার টাকা ভাতা পাচ্ছেন। দুই ঈদে ১০ হাজার টাকা করে আরও ২০ হাজার টাকা ভাতা পান। এ ছাড়া বিজয় দিবসে ৫ হাজার টাকা এবং বাংলা নববর্ষে ২ হাজার টাকা ভাতা পান একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
সবক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের নামের আগে ‘বীর’ শব্দ ব্যবহারের বিধান করে ২০২০ সালের ২৯ অক্টোবর গেজেট প্রকাশ করে সরকার। এ ছাড়া ২০১২ সালে সরকার এক আদেশে সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে যাঁরা মুক্তিযোদ্ধা, তাঁদের ক্ষেত্রে অবসরের বয়স ৬০ বছর করে।
এমনিতে সরকারি চাকরিজীবীদের অবসরে যাওয়ার বয়স ৫৯ বছর। জামুকা সূত্র জানায়, সরকারি চাকরিতে এক বছরের বাড়তি সুবিধা পাওয়ার বিধান যুক্ত হওয়ার পরই মূলত বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা আবেদন করতে থাকেন। তবে মুক্তিযোদ্ধার সনদ পেলেও পরে যাচাই-বাছাইয়ের পর ২০১৪ সালে চাকরিতে থাকা অবস্থায় চারজন সচিব ও একজন যুগ্ম সচিবের আবেদন বাতিল করা হয়।
৫২ বছরে অন্তত সাতবার বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় সংযোজন-বিয়োজন হয়েছে। আর বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার বয়স, সংজ্ঞা ও মানদণ্ড পাল্টেছে ১১ বার।
জামুকা সূত্র বলছে, ১৯৮৪ সালে এরশাদ সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। এ লক্ষ্যে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা হয়। এর আওতায় বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় গঠিত মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের সংগৃহীত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, চট্টগ্রামের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারের (ইবিআরসি) তালিকা এবং ভারত থেকে প্রাপ্ত তালিকা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়, যা জাতীয় তালিকা নামে পরিচিত; এতে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৮।
১৯৮৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেজর জেনারেল আমিন আহমদ চৌধুরী বীর বিক্রম ভারত থেকে একটি তালিকা সংগ্রহ করেন, যা মুক্তিযোদ্ধাদের ভারতীয় তালিকা বলে পরিচিত। এতে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ৬৯ হাজার ৮৩৩ জন।
১৯৯৪ সালে বিএনপি সরকারের আমলে মুক্তিযোদ্ধা কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের তৎকালীন আহ্বায়ক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ জ ম আমিনুল হক বীর উত্তম কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের নির্বাচন পরিচালনার জন্য যে ভোটার তালিকা প্রণয়ন করেন, তাতে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ছিল ৮৬ হাজার। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ১ লাখ ৮৬ হাজার ৭৯০ জনের একটি তালিকা (মুক্তিযোদ্ধাদের) প্রণয়ন করা হয়, যা মুক্তিবার্তা (সবুজ) হিসেবে পরিচিত। পরে আরও যাচাই-বাছাই করে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৪৫২ জনের আরেকটি তালিকা করা হয়, যা মুক্তিবার্তা (লাল) হিসেবে পরিচিত।
জামুকা সূত্র বলছে, ২০০১ থেকে ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট সরকারের আমলে তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব সা’দত হুসাইনকে আহ্বায়ক ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মমতাজ উদ্দিনকে সদস্যসচিব করে ১৫ সদস্যের জাতীয় কমিটি করা হয়।
এই কমিটি ২ লাখ ১০ হাজার ৫৮১ জনকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে অভিযোগ করে, বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের আমলে ৭০ হাজারের বেশি অমুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়েছে।
অমুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা থেকে বাদ দিতে আওয়ামী লীগ সরকার দেশের সব জেলা প্রশাসক ও ইউএনওকে নিয়ে স্থানীয়ভাবে কমিটি করে যাচাই-বাছাই শুরু করে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সরকার নতুন করে আরও সাড়ে ১১ হাজার ব্যক্তির নাম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করে। আর তালিকা থেকে নানা কারণে বাদ পড়েছে প্রায় ২০ হাজার নাম। তবে তালিকায় নতুন নাম অন্তর্ভুক্তি বন্ধ হয়নি।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির প্রথম আলোকে বলেন, বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় এখনো সব প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম ওঠেনি, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধে যাননি এমন অনেক লোকের নাম তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
ইদানীং প্রভাবশালী বা ক্ষমতাবানেরা তাঁদের দুষ্কর্ম ঢাকতে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম ওঠাতে দৌড়ঝাঁপ করছেন। যদি কোনো স্বাধীন কমিশন দিয়ে এমআইএসের (ভাতা পাওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পূর্ণাঙ্গ তথ্য সরকার ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম বা এমআইএস নামে একটি সফটওয়্যারে যুক্ত করেছে) তালিকা যাচাই-বাছাই করা হয়, তাহলে হয়তো অর্ধেকও টিকবে না।
এমনও অভিযোগ রয়েছে টাকা দিতে পারেননি বলে অনেকে তালিকায় নাম ওঠাতে পারেননি। তাই কখনো মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা নির্ভুল হবে না। শুধু অসচ্ছলদের ভাতা দেওয়ার নিয়ম করলেই তালিকা থেকে অমুক্তিযোদ্ধাদের বাদ দেওয়া সম্ভব হবে।