খুব আচমকা একদিন খেয়াল করলাম, আমার মেয়েটা বড় হয়ে গেছে! অথচ এই কদিন আগেও, এই তো সেদিন, প্রতি রাতে প্রবল আবদার ছিল তার, ‘বাবান, একটা গল্প বলো।’
১.
রূপকথার গল্প শুনতে শুনতে সে একদিন বলে উঠল, ‘বাবান, অন্য গল্প বলো।’
আমার বুঝে ওঠার প্রথম ধাপ—মেয়েটা বড় হচ্ছে একটু একটু; সে এখন বিজয়ীর গল্প শুনতে চায়; কোনো একটা কিশোর নায়ক উঁকি দিচ্ছে তার মননে, চিন্তায়। ঠিক তখনই ‘বিল্লু’ এসে যায় আমার গল্পে, যে কিশোর সব পারে, যার কাছে সব অসম্ভব সম্ভবে রূপ নেয়।
কোনো কোনো রাতে চরম ঘুম পেয়ে যায় একটু আগেই। প্রতিদিন স্কুলে যাওয়া দায়িত্ববান শিক্ষকের মতো মেয়ে আমার পাশে এসে বসে, বুকের মাঝখানে হাত রাখে, বোলাতে থাকে আপনমনে, দাবির স্বরটা কাতরতায় এনে বলে, ‘বাবান, বিল্লুর গল্প বলো না।’
চোখ বুজে থাকি ঘুমের কাতরতায়, চোখের পাতা টেনে ধরে ও, খুলতে চায় কিছুটা শক্তি প্রয়োগে, আমি ঘুমের আবেশে বিল্লুর গল্প বলে যাই, ও বুকে মাথা রাখে আমার। একটু থেমে গেলেই তাড়া দেয়, ‘বাবান, তারপর?’
তারপর একসময় দেখি, মেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে বুকে মাথা রেখেই, আমার ঘুম উধাও। আলতো করে পাশে শুইয়ে দিই ওকে, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রূপবতী আর রাজকন্যার মুখ ছায়া ফেলে আমার চোখে। বটবৃক্ষের মতো শান্ত-স্থিরতায় ওপাশে বসে থাকা ওর মা কাতর গলায় বলে, ‘তুমি কাঁদছ!’
হাতের চেটো দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বলি, ‘না, এমনি।’
২.
‘বাবান, তুমি কী ন্যাখো?’
রোজ সকালে নিয়ম করে লিখতে বসার অভ্যাস ছিল আমার। মেয়ে ঘুম থেকে উঠেই সোজা আমার রুমে। অনেকটা জোর করে কোলে উঠেই তার প্রথম প্রশ্ন, ‘বাবান, তুমি কী ন্যাখো?’
ল্যাপটপের কি-বোর্ড আর ভালো লাগে না আমার। আমি আমার মেয়ের মুখ দেখি, সকালের স্নিগ্ধতা দেখি, জগতের সব পরিস্ফুটনের আভিজাত্য দেখি, বর্ণিল যাবতীয় ফুলের আভা দেখি, রংধনু আর মেঘের কারুকাজ দেখি, প্রকৃতির সব আয়োজন দেখি।
আমার কত গল্প খেই হারিয়ে ফেলেছে কি-বোর্ডে আর হাত না রাখার অনিচ্ছায়! আমি মেয়ের গল্প শুনি, গল্পের মুগ্ধতায় ওর চিরসুবাস চুলে মুখ গুঁজে দিই, সব পাওয়ার স্বপ্ন আর আকাঙ্ক্ষায় জড়িয়ে ধরি ওকে দু-হাতে, পূর্ণতার আকুলতায় হারিয়ে ফেলি নিজেকে!
৩.
স্কুলে যাওয়া শুরু করে মেয়ে একদিন। বলে যায়, ‘বাবান, আসি।’ ফিরে আসে বাসায়, আমি ফিরি রাতে। মেয়ে দৌড়ে আসে কাছে, ‘বাবান, তুতুন না আজ কী করেছে, জানো?’
চাকরি নামের দাসত্বের সব ক্লান্তি দূর হয়ে যায় আমার নিমেষেই। জুতা খুলতে খুলতে আমি গল্প শুনি ওর চোখে চোখ রেখে। মনোযোগের যেন একটুও হেরফের না হয়, ও যেন আমার চিবুক সোজা করে না বলে, ‘বাবান, শোনো না!’
তারপর খেয়াল করি, আমি আর আমি নেই, আমি হয়ে গেছি সেই ছোটকালের সুমর্মি; এই একটু বড় হয়ে যাওয়া আমার মেয়েটা হয়ে গেছে সেই আমি—তাৎক্ষণিক সৃজনশীলতার সব উপকরণের বিল্লুর গল্পে মজে গেছি আমি!
রাত শুরু হতো একদিন আমার গল্প শুনে তার, এখন আমার শুরু হয় তার গল্প শুনে!
৪.
একদিন অকস্মাৎ আমি টের পেয়ে যাই, আমার মেয়েটা আর আমার সঙ্গে গল্প বলে না, যেন সব গল্প শেষ হয়ে গেছে আমাদের দুজনের। কাছে আসে না যখন-তখন, যেন প্রয়োজন নেই কোনো আদান-প্রদানের। এড়িয়ে চলে তেঁতুলতলার রাতের মতো অজানা এক ভীতিতে।
তারপর ওর মা এসে কানে কানে কী একটা বলে যায় আমাকে, আমি জেনে যাই, আমার মেয়েটা বড় হয়ে গেছে! তারপর আমি চেয়ে চেয়ে দেখি, তার সব গল্পই এখন তার মায়ের সঙ্গেই। এত হাসি-কান্না, জগতের এত রূপ-রস, গোপন কথার সব আয়োজনে কেবল ওই মা।
আমি কেউ না, কেউ ছিলাম না যেন কখনো।
তারও কয়েক দিন পর কষ্টে ডুবে যাই, নিগূঢ় বাস্তবতায় উপলব্ধি করি—কত দিন মেয়ের সঙ্গে কথা হয় না আমার, একসঙ্গে টেবিলে বসে খাই না অনেক দিন; তার পছন্দের জামা-কাপড়ে আমার আর কোনো মতামত নেই। তার নিজস্বতা, স্বাধীনতা আর স্বপ্নে আমি দূর আকাশের তারা—মিটিমিটি আলো দিয়ে যাই, চেয়ে দেখি কেবল নীরবে।
৫.
অথচ কত কথা বলার আছে আমাদের! খুব বলতে ইচ্ছা করে, ‘মা, চল্ না, আমাদের প্রশস্ত জানালায় বসে রবীন্দ্রসংগীত শুনি দুজনে, চা আর সবজি পাকোড়ায় তোর মা–ও বসল নাহয় পাশে দুজনের। শিশিরে কত দিন খালি পায়ে হাঁটা হয় না, চল্, পা ভিজিয়ে আসি ঘাসের আদরে। সমুদ্রবালিতে গড়াগড়ি করিস তুই সেই শৈশবের বাচ্চামিতে, আরও একদিন বালিতে শরীর ডুবালে কী হয়! মাঝে মাঝে সেই বিশেষ দিনগুলোতে পেটে ব্যথা হয় তোর, তোর মা আপ্রাণ চেষ্টায় হাত বুলিয়ে দেয় তোর ব্যথা প্রশমনে। আমার বুঝি বসতে ইচ্ছা করে না তোর পাশে, তোর গা-স্পর্শে!
৬.
‘পিতা তার নিজের অস্তিত্ব বিলিয়ে দেন নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে। আর এ কাজ তিনি এত নীরবে করেন যে আমরা ভুলে যাই তিনি আছেন, তাঁর ছায়াতেই বেঁচে আছি আমরা। একজন বাবা হচ্ছেন সবচেয়ে আনসাং, সবচেয়ে আননোটিশড, কিন্তু সবচেয়ে ভ্যালুয়েবল মানুষ। যতক্ষণ পর্যন্ত তিনি থাকেন, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি যে আছেন, বুঝতে দেন না এটাও...।’
কোনো একটা লেখায় পড়েছিলাম ওপরের কথাগুলো।
বাবার হাত ধরে, আঙুল চেপে যে সন্তানটা বড় হয়, বাবারও একদিন ইচ্ছা করে জান্তব লাঠিটা ছেড়ে একটা হাত ধরতে, আঙুল ধরে হাঁটতে!
বাবারা তাই সব অব্যক্ত কথায় বসে থাকেন জানালায় কিংবা কোনো খোলা মাঠ অথবা গাছতলায়, কেউ একজন, কেউ খুব নীরবে পিঠে হাত রেখে বলবে, ‘বাবা, চলো না, ওইখানটায় হাঁটি। তোমার সঙ্গে কত গল্প আমার!’
সব লেনদেনের সব শেষে বাবা শেষ পর্যন্ত একা—একে একে ঝরে পড়া পাতাদের মাঝে!