প্রিয় পাঠক, প্রথম আলোয় নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে আপনাদের লেখা। আপনিও পাঠান। গল্প-কবিতা নয়, বাস্তব অভিজ্ঞতা। আপনার নিজের জীবনের বা চোখে দেখা সত্যিকারের গল্প; আনন্দ বা সফলতায় ভরা কিংবা মানবিক, ইতিবাচক বা অভাবনীয় সব ঘটনা। শব্দসংখ্যা সর্বোচ্চ ৬০০। দেশে থাকুন কি বিদেশে; নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বরসহ পাঠিয়ে দিন এই ঠিকানায়: readers@prothomalo.com
তখন (১৯৬৬ সাল) সম্ভবত আমরা অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে পড়ি। বিকেল হলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের বিশাল বিস্তৃত ঘাসে মোড়া লনটা কী চমৎকার চেহারা ধারণ করত! রোদ পড়ে গেছে, ওপরে নীল আকাশ, লনের স্থানে স্থানে মৌসুমি ফুলের কেয়ারি অথবা ছেঁটে রাখা ফুল গাছের ঝোপ, এক পাশে টলটলে পানি নিয়ে চমৎকার দিঘি! যেহেতু মুঠোফোন বা ল্যাপটপের যুগ সেটা ছিল না, তাই বিকেল হলেই আমরা দল বেঁধে পাখির ঝাঁকের মতো নিচে নেমে যেতাম। পায়চারি, বাদাম চিবানো আর হিহি–হোহো করার সঙ্গে সঙ্গে বকবক চালিয়ে যাওয়া—সন্ধ্যা পর্যন্ত এসবই চলত।
দিঘিটার একপাশে ছিল চমৎকার শানবাঁধানো ঘাট। অন্য তিন পাশে অজস্র ছোট–বড় প্রাচীন বৃক্ষ। দিঘিতে একটা ছোট্ট নৌকাও বাঁধা থাকত। দিঘির পানিতে পা ডুবিয়ে ঘাটে বসে বসে গল্পে মত্ত হওয়াটাও ছিল আমাদের অন্যতম বিনোদন। আর কথা বলার সময় দু–তিনজন একই সময় কথা বলে যাওয়া—কে শোনে কার কথা! ছেলেরা সাধারণত একজন কথা বললে অন্যরা আগে চুপ করে শোনে। মেয়েদের মধ্যে যেন এসব ভব্যতার বালাই নেই!
তো একদিন ঘাটে বসে আমরা এ রকমই জম্পেশ আড্ডায় মত্ত। হঠাৎ শখ চাপল, নৌকা বেয়ে বেয়ে দিঘির চারপাশটায় একটু ঘুরে বেড়াই না কেন! উঠল বাই, তো কটক যাই! উত্তেজনায় সবাই লাফ দিয়ে উঠে পড়ল, ‘আমি যাব, আমি যাব।’ কার্যত দেখা গেল যে বেশির ভাগই সাঁতার জানে না! আমি তো মহা কনফিডেন্ট! ছোটবেলায় নিজেদের পুকুর আর চামটি নদীতে (দাদার বাড়ি) কত ঝাঁপাঝাঁপি করেছি না!
চট করে শাড়ি কোমরে পেঁচিয়ে আমরা তরতর করে নৌকায় উঠে বসলাম। অবশিষ্টরা করুণ চোখে তাকিয়ে রইল। ভাবখানা এমন, তোরা একচক্কর ঘুরে আয়; তারপর দেখিস, আমাদের নেওয়া যায় কি না।
মহানন্দে নৌকায় বসে পাকা মাঝিরা যেমন বইঠা বা লগির মাথা পাড়ে ঠেকিয়ে একটু ঠেলা দিয়ে পানির মধ্যে এগিয়ে নেয়, আমরাও তা–ই করলাম। তারপর দুজন দুই মাথায় বসে বইঠা বাইতে শুরু করলাম। ও খোদা, নৌকা এগোয় না! একই জায়গায় যেন অনিচ্ছাকৃতভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে! অনেক চেষ্টার পর অনুধাবন করলাম, নৌকা বাইতে পারার কায়দাটাও জানতে হয়!
একে তো গলদঘর্ম, নাস্তানাবুদ অবস্থা, ওদিকে ঘাট থেকে এক্সপার্ট (!) মাঝিরা সমস্বরে নির্দেশনা দিয়েই যাচ্ছে! ‘ডান দিকে চাপ দে, বাঁ দিকে দে, ওপরে দে, নিচে দে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। এ রকম করতে করতে নৌকা নিজের গুণেই কেমন করে যেন বেশ খানিকটা গভীরে চলে গেছে। হঠাৎ চোখে পড়ল, কাছেই লাল শাপলা অথবা পদ্ম ভাসছে। সবাই ‘আমি ফুল নেব, আমি ফুল নেব’ বলে নৌকার যে মাথা ফুলের কাছাকাছি ছিল, সেই দিকে একজনের ওপর দিয়ে আরেকজন গিয়ে ঝুঁকে পড়তেই, মাথাটা নিচু হয়ে নৌকায় ফটাফট পানি উঠতে শুরু করল। মুহূর্তের মধ্যেই আমরা বুঝতে না বুঝতেই নৌকা গেল ডুবে।
হায় আল্লাহ, পাকা আমের মতো আমরা সব টপাটপ পানিতে পড়ে গেলাম। আচমকা পড়ে যাওয়ায় পানির বেশ গভীরে তলিয়ে যাচ্ছিলাম। নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। আমি ভাবলাম, বুঝি ডুবেই যাচ্ছি! কিন্তু সাঁতার জানা থাকায় কিছুক্ষণ পর হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে ভেসে উঠলাম। গভীর একটা শ্বাস নিলাম। মারা যাওয়ার আতঙ্কটা গেল। অন্য কজনও আমারই মতো নাকানিচুবানি খেয়ে খেয়ে ভেসে উঠছে। মজার ব্যাপার হলো, তাকিয়ে দেখি, নৌকাটা পুরোপুরি ডুবে না গিয়ে উল্টো হয়ে ভাসছে। একে তো ভয় পেয়ে সাঁতার কাটতে পারছি না, তার ওপর প্যাঁচ খুলে শাড়ির আঁচল লম্বা হয়ে কোথায় চলে গেছে, কুঁচিগুলোও খুলি–খুলি ভাব! কোনোমতে গিয়ে উল্টো নৌকাটাকে এক হাতে ধরে সবকিছু সামাল দিলাম। সবারই এক অবস্থা। উল্টো নৌকাকে ধরে ঠেলে ঠেলে এগিয়ে, একপর্যায়ে যখন পায়ের নিচে সিঁড়ির ছোঁয়া পেলাম, মনে হলো, আল্লাহ্ বাঁচিয়েছেন, হাজার শোকর!
নাস্তানাবুদ হয়ে ভেজা কাপড়ে সপসপ করে ওপরে উঠতেই অপেক্ষমাণ বন্ধুরা সমস্বরে হো হো করে হেসে উঠল! আমরাও মুহূর্তমাত্র ভ্যাবাচেকা খেয়ে পরক্ষণেই ওদের সঙ্গে হাসিতে যোগ দিলাম। পেছনে ভাসমান উল্টো নৌকাটাকে যেন মনে হলো আমাদের ভেংচি কাটছে!
দিলারা হাফিজ, সাবেক মহাপরিচালক, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর