প্রথম আলোর রাজশাহী কার্যালয়ে গত সোমবার হামলা চালিয়ে সাইনবোর্ড খুলে নিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী একদল ব্যক্তি
প্রথম আলোর রাজশাহী কার্যালয়ে গত সোমবার হামলা চালিয়ে সাইনবোর্ড খুলে নিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী একদল ব্যক্তি

প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে অপতৎপরতায় উদ্বেগ

প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার-এর কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ এবং প্রথম আলোর রাজশাহী ও বগুড়া কার্যালয়ে হামলাসহ পত্রিকা দুটির বিরুদ্ধে অপতৎপরতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছেন দেশের ৩৪ বিশিষ্ট নাগরিক।

মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে এই উদ্বেগের কথা জানান বিশিষ্ট নাগরিকেরা। একই সঙ্গে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান ও সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সুরক্ষায় সরকারসহ সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা।  

বিবৃতিদাতাদের মধ্যে রয়েছেন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, আবুল কাসেম ফজলুল হক, সুলতানা কামাল, আনু মুহাম্মদ, খুশী কবির, জেড আই খান, শহিদুল আলম, সুব্রত চৌধুরী, রেহনুমা আহমেদ, শামসুল হুদা, স্বপন আদনান, সালমা আলী, সারা হোসেন, তবারক হোসেন, রোবায়েত ফেরদৌস, সামিনা লুৎফা, জোবায়দা নাসরিন, মনীন্দ্র কুমার নাথ, সালেহ আহমেদ, খাইরুল ইসলাম চৌধুরী, তাসলিমা ইসলাম, সাদাফ নুর, জাকির হোসেন, মিনহাজুল হক চৌধুরী, রেজাউল করিম চৌধুরী, সায়দিয়া গুলরুখ, ফারহা তানজিম, আশরাফ আলী, শুভ্র চক্রবর্তী, শাহদাত আলম, রুশাদ ফরিদী, মাহবুব হাসান, দীপায়ন খীসা ও হানা শামস আহমেদ।

বিবৃতিতে বলা হয়, গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভের সঙ্গে লক্ষ করা যাচ্ছে যে গত সোমবার দুপুরে প্রথম আলো ও দ্য ডেইলি স্টার পত্রিকার বিরুদ্ধে ‘আলেম ওলামা ও তাওহিদী জনতা’র ব্যানারে রাজশাহীর সাহেব বাজার জিরো পয়েন্ট থেকে বিক্ষোভ মিছিল বের করা হয়। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে এসে প্রথম আলোর কার্যালয়ের সাইনবোর্ড ভাঙচুর ও তাতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। একই দিন রাতে বগুড়ার জলেশ্বরীতলায় প্রথম আলোর আঞ্চলিক কার্যালয় লক্ষ্য করে হেলমেট ও মুখোশধারী ১৫-১৬ জন ইটপাথর ছোড়ে এবং কার্যালয়ের ডিজিটাল সাইনবোর্ড ভাঙচুর করে।

এই হামলার আগে ২১ নভেম্বর থেকে ঢাকায় প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে এবং পরদিন ২২ নভেম্বর ঢাকায় ডেইলি স্টার ও প্রথম আলোর কার্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ করা হয়। এরপর ২৪ নভেম্বর ঢাকার কারওয়ান বাজারে প্রথম আলো কার্যালয়ের সামনে ‘বাংলাদেশের জনগণ’-এর ব্যানারে গরু জবাই করা ও বিক্ষোভ সমাবেশ কর্মসূচি দেন বিক্ষোভকারীরা। তাঁদের দাবি ছিল, ‘প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার ভারতীয় আগ্রাসনে সহায়তা করছে। ফলে তাদের তওবা করার জন্য এ জিয়াফত কর্মসূচি। এখানেই রান্না করে সবাইকে খাওয়ানো হবে।’ ওই দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত তাঁদের এই কর্মসূচি চলে। এরপর পুলিশ তাঁদের চলে যেতে বললে তাঁরা আপত্তি জানান। একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে তাঁদের বাগ্‌বিতণ্ডা এবং পাল্টাপাল্টি ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সংবাদকর্মীসহ ওই স্থানের অন্যদের জন্য ভীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়। ওই দিন প্রথম আলোর চট্টগ্রাম কার্যালয়ের সামনেও মিছিল করা হয়।

বিবৃতিতে বিশিষ্টজনেরা বলেন, এহেন ধৃষ্টতাপূর্ণ সহিংস আক্রমণ ও সন্ত্রাসী তৎপরতা শুধু দুটি স্বনামধন্য দৈনিকের ওপর নয়, সমগ্র সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার ওপর আক্রমণ এবং সংবাদকর্মীদের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। তাঁরা বলেন, ‘আমরা সুস্পষ্টভাবে বলতে চাই, স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের অধিকার সকলের আছে। সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত কোনো খবর বা প্রতিবেদনের বিষয়ে অভিযোগ থাকলে সে জন্য যথাযথ, আইনানুগ কিংবা গঠনমূলক প্রক্রিয়া অবলম্বন না করে পত্রিকা বন্ধ করতে বিক্ষোভ ও হামলার ঘটনা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।’ তাঁরা বলেন, বিক্ষোভে অংশগ্রহণকারীদের অভিযোগ, ডেইলি স্টার ও প্রথম আলো বাংলাদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের জঙ্গি বানানোর কারিগর হিসেবে কাজ করে। এটি একটি গুরুতর অভিযোগ এবং কিসের ভিত্তিতে তাঁরা এই অভিযোগ করছেন, তা বোধগম্য নয়। কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ ছাড়া এ ধরনের ঢালাও অভিযোগ, উসকানি ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিদ্বেষ ছড়ানোর পেছনে কোনো স্বার্থান্বেষী মহলের দুরভিসন্ধি রয়েছে কি না, তা যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে খতিয়ে দেখা জরুরি।

বিবৃতিতে বলা হয়, যে দুটি পত্রিকাকে লক্ষ্য করে উসকানি ও বিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে, সেই দুটি পত্রিকা সদ্য পতিত স্বৈরাচারী সরকারের আমলেও নানাভাবে মামলা ও হয়রানিসহ শাসকগোষ্ঠীর রোষানলে পড়ে কালো তালিকাভুক্ত হয়েছিল। পত্রিকা দুটির সম্পাদকদের বিরুদ্ধে বিগত সরকারের দলীয় কর্মীরা কয়েক ডজন হয়রানিমূলক মামলা দায়ের করেছিলেন। স্বৈরশাসন অবসানের পর সমাবেশ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সুযোগকে অপব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক উসকানি ও বিদ্বেষ ছড়িয়ে বিশৃঙ্খলা তৈরির মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল ও অকার্যকর করার উদ্দেশ্যের অংশ হিসেবে এ দুটি পত্রিকার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ও হামলার ঘটনাগুলো ঘটছে বলে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।

এই ঘটনাগুলোকে নতুন করে ভয়ের সংস্কৃতি সৃষ্টির অপচেষ্টা বলে মনে করেন বিবৃতিদাতারা। তাঁরা বিষয়টিকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তদন্তের মাধ্যমে উসকানিদাতা ও তাঁদের ইন্ধনদাতাদের দ্রুত শনাক্ত করে তাঁদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। গণমাধ্যম কার্যালয়ে ভাঙচুরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার যে অঙ্গীকার তথ্য উপদেষ্টা ব্যক্ত করেছেন, তাঁরা সেটিকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁরা জনগণকে যেকোনো ধরনের উসকানি ও বিভ্রান্তি থেকে সতর্ক থাকা এবং সংবাদমাধ্যমের সুরক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।