যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখেও ঢাকার অবস্থানের প্রশংসা লাভরভের

যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দিচ্ছেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ। গতকাল ঢাকায়
ছবি: প্রথম আলো

যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের চাপের পরও জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করায় বাংলাদেশের প্রশংসা করেছেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ। তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম অংশীদার বাংলাদেশের সঙ্গে রাজনৈতিকসহ সর্বস্তরে সম্পর্ক জোরদারে আগ্রহী রাশিয়া।

গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ঢাকা সফরের প্রথম দিনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনকে পাশে রেখে সংবাদ সম্মেলনে সের্গেই লাভরভ বাংলাদেশের প্রতি তাঁর দেশের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন। দিল্লিতে আগামীকাল শনিবার থেকে অনুষ্ঠেয় জি–২০ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার আগে তিনি ঢাকায় এলেন। আজ শুক্রবার সকালে তিনি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পর দিল্লি যাবেন।

গতকাল সন্ধ্যায় ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তা থেকে বিশেষ ফ্লাইটে সের্গেই লাভরভ ঢাকায় আসেন। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে তিনি সরাসরি রাজধানীর ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলে এসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনের সঙ্গে একান্তে বৈঠক করেন। এরপর দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁদের প্রতিনিধিদলকে নিয়ে ঘণ্টাখানেক দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে তাঁরা যৌথ সংবাদ সম্মেলনে অংশ নেন।

সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে সের্গেই লাভরভ বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় রাশিয়ার অন্যতম প্রধান অংশীদার এবং পরীক্ষিত বন্ধু হিসেবে অভিহিত করেন। তিনি জানান, ভবিষ্যতে দুই দেশের সর্বস্তরে সম্পর্ক বাড়ানোর বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে। রাজনৈতিক সম্পর্ক কার্যকরভাবে জোরদারের জন্য সম্ভাব্য প্ল্যাটফর্ম নিয়ে আলোচনা হয়েছে তাঁদের।

রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্যবসা ও বিনিয়োগ বাড়ানো, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের

কাজ এগিয়ে নেওয়ার পাশাপাশি রাশিয়ার রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি গাজপ্রমের গ্যাসকূপ খনন অব্যাহত রাখা, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহসহ দ্বিপক্ষীয় নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন। রাশিয়া থেকে ভবিষ্যতে গম ও সার বিক্রির বিষয়ে স্থায়ী রূপরেখা নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠকে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে আলোচনার প্রসঙ্গ টেনে সের্গেই লাভরভ বলেন, ‘রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও আমরা আলোচনা করেছি। বিষয়টি সমাধানের জন্য আমরা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে অ্যাডহক ওয়ার্কিং গ্রুপের আলোচনাকে সমর্থন করি। বাইরের পক্ষগুলো যেন (সমস্যা সমাধানে) অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে নিজেদের সীমিত রাখে। রাশিয়া এই কাজই মিয়ানমারের সঙ্গে করছে এবং ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত রাখবে। এরপরও বাইরের কিছু শক্তি এই ইস্যুকে ব্যবহার করে একটি পক্ষের ওপর চাপ প্রয়োগের বিষয়টি সামনে আনছে এবং অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানোর চেষ্টা করছে। আমি মনে করি দুটো উদ্যোগই হিতে বিপরীত হবে, যা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। জাতিসংঘ, আসিয়ান আঞ্চলিক ফোরামসহ নানা আন্তর্জাতিক ফোরামে রাশিয়া এ সমস্যা নিয়ে কাজ করছে।’

সের্গেই লাভরভ বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের চাপের পরও বাংলাদেশ জাতীয় স্বার্থের ভিত্তিতে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে চলেছে, যা প্রশংসনীয়।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইঙ্গিত করে এক প্রশ্নের উত্তরে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যদি পরিস্থিতি বিবেচনা করি, তাহলে দেখব ভারত মহাসাগরীয় কৌশলের নামে তাদের লক্ষ্য চীনকে প্রতিহত ও রাশিয়াকে একঘরে করে ফেলা, যা কার্যত বৈশ্বিক পরিসরে ন্যাটোর সম্প্রসারণেরই অংশ।’

আলোচনা শেষে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ (বাঁয়ে) ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। গতকাল রাতে রাজধানীর একটি হোটেলে

বাংলাদেশ তার পররাষ্ট্রনীতিতে অটুট থাকবে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ সংলাপ ও আলোচনার মাধ্যমে যেকোনো সংকট সমাধানের পক্ষে। আমরা এ অঞ্চলে “প্রক্সি ওয়ার” চাই না।’

নিষেধাজ্ঞাসহ বিভিন্ন উপায়ে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে বাংলাদেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের চাপ আছে কি না জানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেন, ‘আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হচ্ছে “সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়।” আমরা ভারসাম্য কূটনীতি মেনে চলার চেষ্টা করি। আমরা আমাদের আগ্রহকে গুরুত্ব দিই। আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি।’

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আজকে আমরা আলোচনার মধ্যে অনেক ইস্যু তুলে নিয়ে এসেছি। আমাদের ইস্যু ছিল রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, এটা মোটামুটি যথা সময়ে শেষ হবে। রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এ ইস্যুতে তারা (রাশিয়া) আমাদের সঙ্গে একাত্ম।’

রাশিয়া বাংলাদেশকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস এবং অপরিশোধিত তেল আনার প্রস্তাব দিয়েছে জানিয়ে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘তাঁদের দেশ থেকে আমরা এলএনজি আনতে পারি। তাঁরা আমাদের প্রস্তাব করেছেন, তাঁদের দেশ থেকে অপরিশোধিত তেল আনতে পারি।’

ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশও ব্যবসা-বাণিজ্যে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানান আব্দুল মোমেন। তিনি বলেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে অসুবিধা সৃষ্টি হয়েছে, সেটি তুলে ধরেছি। আমরা বলেছি, তাঁদের দেশে অর্থনৈতিক একটা কমিশন আছে, আমরা তার সুবিধা নিতে চাই। বাকি রাষ্ট্র যারা সদস্য, বিশেষ করে কাজাখস্তান, তাদের অনুমতি লাগবে। সবাই মিলে যেন সিদ্ধান্ত নেয়।’