ডেঙ্গু বাড়ছে, শিরায় দেওয়া স্যালাইনের সংকট কাটছে না

৯ জেলার সরকারি হাসপাতালের পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করেছেন প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা। ৭ হাসপাতালে স্যালাইনের সংকট দেখা গেছে।

রক্তের তারল্য ঠিক রাখতে ও রক্তচাপ স্থিতিশীল রাখতে ডেঙ্গু ও ডায়রিয়ার রোগীকে স্যালাইন দিতে হয়
ফাইল ছবি : প্রথম আলো

বিভিন্ন জেলায় শিরায় দেওয়া স্যালাইনের সংকট চলছে। একাধিক সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীদের চাহিদামতো স্যালাইন দিতে পারছেন না চিকিৎসকেরা। এমন পরিস্থিতিতে ভারত থেকে স্যালাইন আমদানি শুরু করেছে সরকার।

গতকাল শনিবার বরিশাল, খুলনা ও চট্টগ্রাম বিভাগের ৯ জেলার সরকারি হাসপাতালের শিরায় দেওয়া স্যালাইনের পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করেছেন প্রথম আলোর প্রতিনিধিরা। সাত জেলায় সরকারি হাসপাতালে স্যালাইনের সংকট দেখা গেছে। একাধিক জেলায় বাজারেও শিরায় দেওয়া স্যালাইন কিনতে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক ক্ষেত্রে বেশি দাম দিয়ে স্যালাইন কিনতে হচ্ছে।

সরকারি প্রতিষ্ঠানে স্যালাইন উৎপাদন হয় না। শিরায় দেওয়া স্যালাইন উৎপাদন করে ছয়টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে স্যালাইন কেনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একমাত্র ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল)। ইডিসিএল সেসব স্যালাইন সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এই ছয় কোম্পানি মাসে সাড়ে ৪৬ লাখ ব্যাগ স্যালাইন উৎপাদন করে। এর মধ্যে আছে সাধারণ স্যালাইন, গ্লুকোজ মিশ্রিত সাধারণ স্যালাইন ও কলেরার স্যালাইন।

ইডিসিএলের বিক্রয় ও বিপণন বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক মো. জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আগস্টে আমরা সাড়ে আট লাখ ব্যাগ স্যালাইন সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করেছি। সেপ্টেম্বরের ১৪ দিনে সরবরাহ করেছি সাড়ে তিন লাখ ব্যাগ।’

বাজারে কেন স্যালাইন সংকট চলছে—এমন প্রশ্নের উত্তরে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক মো. সালাহউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, ডেঙ্গু রোগীর কারণে স্যালাইনের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। ওষুধ কোম্পানিগুলো ২৪ ঘণ্টা উৎপাদনে আছে। তারপরও চাহিদার পুরোটা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমস্যার কথা শোনা যাচ্ছে। আমদানি করা স্যালাইন দেশে পৌঁছালে সমস্যা আর থাকবে না।

সরকারি প্রতিষ্ঠানে স্যালাইন উৎপাদন হয় না। শিরায় দেওয়া স্যালাইন উৎপাদন করে ছয়টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। সরকারিভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে স্যালাইন কেনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একমাত্র ওষুধ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসেনসিয়াল ড্রাগস কোম্পানি লিমিটেড (ইডিসিএল)।

সংকট বরিশালের তিন জেলায়

বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, পুরো ওয়ার্ড রোগীতে ভরা। পিরোজপুর থেকে আসা মেহেদী হাসান (২৭) শুক্রবার এখানে ভর্তি হন। সেদিন তাঁর জন্য বাইরে থেকে স্যালাইন কিনতে হয়েছে। গতকালও তাঁর জন্য হাসপাতালের বাইরে থেকে স্যালাইন কেনা হয়েছে।

হাসপাতাল সূত্র জানায়, দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় এই হাসপাতালেও সাধারণ স্যালাইন (এনএস) ও গ্লুকোজ-সোডিয়াম ক্লোরাইড (ডিএনএস) উভয় স্যালাইনের মজুতে ঘাটতি পড়েছে।

ওষুধের দোকানগুলোতেও এই সংকট রয়েছে। সাগরদী এলাকার অন্তত চারটি ফার্মেসির মালিক ও ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিরা বলেন, কোম্পানিগুলো চাহিদা অনুযায়ী স্যালাইন সরবরাহ করতে পারছে না।

শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক মনিরুজ্জামান শাহিন প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্যালাইনের কিছুটা ঘাটতি আছে। আমরা ২০ হাজার স্যালাইন চেয়ে চাহিদাপত্র দিয়েছি। এটা পেলে সংকট কেটে যাবে।’

বরিশালের এই হাসপাতালেই শুধু নয়, বিভাগের একাধিক জেলায় স্যালাইনের ঘাটতি আছে। বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) তাসকিয়া সিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালে এনএস, ডিএনএস—দুই ধরনের কোনো স্যালাইনই নেই।

বরগুনা শহরের অপূর্ব মেডিকেলের মালিক বিজন কান্তি বলেন, চাহিদার তুলনায় কোম্পানিগুলো স্যালাইন সরবরাহ করতে পারছে না।

পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও স্যালাইনের মজুতে ঘাটতি আছে বলে জানা গেছে। পিরোজপুরের নেছারাবাদ, বরগুনার আমতলী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেও স্যালাইনের সংকট চলছে বলে জানা গেছে।

আগস্টে আমরা সাড়ে আট লাখ ব্যাগ স্যালাইন সরকারি হাসপাতালে সরবরাহ করেছি। সেপ্টেম্বরের ১৪ দিনে সরবরাহ করেছি সাড়ে তিন লাখ ব্যাগ।
মো. জাকির হোসেন, ইডিসিএলের বিক্রয় ও বিপণন বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক

এ প্রসঙ্গে বরিশাল বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক শ্যামল কৃষ্ণ মণ্ডল প্রথম আলোকে বলেন, ডেঙ্গু রোগীর চাপ বেড়ে যাওয়ায় স্যালাইনের চাহিদা স্বাভাবিক অবস্থার চেয়ে কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। উৎপাদন ও সরবরাহ কিছু শ্লথ। তিনি বলেন, তাঁরা সম্প্রতি প্রতিটি হাসপাতালের জন্য ৫০০ করে ১৮ হাজার ৫০০ স্যালাইনের চাহিদাপত্র দিয়েছেন। এটা পাওয়া গেলে সংকট থাকবে না।

সংকট চট্টগ্রাম শহরেও

চট্টগ্রামে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালগুলোতে স্যালাইন সংকট চলছে।

গতকাল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ডেঙ্গু ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি শয্যায় রোগীদের স্যালাইন দেওয়া হচ্ছে। হাটহাজারী থেকে আসা মো. মহিউদ্দিন নামের এক যুবক গত শুক্রবার ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হন। ডেঙ্গুর পাশাপাশি তাঁর ডায়রিয়া দেখা দিয়েছে। তাঁকে দুটি কলেরা স্যালাইন দেওয়া হয়। মহিউদ্দিন বলেন, এই দুটি স্যালাইন তাঁরা বাইরে থেকে কিনে এনেছেন।

অবশ্য হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শামীম আহসান বলেন, তাঁর কাছে আরও কয়েক দিন চালানোর মতো স্যালাইন রয়েছে।

সরকারি হাসপাতালের পাশাপাশি চট্টগ্রামে ডেঙ্গু রোগীদের বড় একটি অংশ চিকিৎসা নিচ্ছে আগ্রাবাদ মা ও শিশু জেনারেল হাসপাতালে। এই হাসপাতালেও পর্যাপ্ত স্যালাইন নেই বলে জানান হাসপাতালটির পরিচালক মো. নুরুল হক। তিনি বলেন, ‘আমরা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানকে ৫০০ কার্যাদেশ দিলে তারা দেয় ১০০টি। এভাবে চলছে।’

স্থানীয় ওষুধ দোকানগুলোতে পর্যাপ্ত স্যালাইন নেই বলে দাবি করেন বিক্রেতারা। ওষুধ দোকানমালিকদের সংগঠন চট্টগ্রাম কেমিস্ট অ্যান্ড ড্রাগিস্ট সমিতির সহসভাপতি আশীষ ভট্টাচার্য বলেন, কোম্পানিগুলো চাহিদামতো স্যালাইন সরবরাহ করতে পারছে না।

ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের চট্টগ্রামের উপপরিচালক এস এম সুলতানুল আরফিন বলেন, সিটি করপোরেশন এলাকায় স্যালাইনের সংকট আছে। স্যালাইন যা আসছে, তা দিনে দিনেই শেষ হয়ে যাচ্ছে।

ওষুধ কোম্পানিগুলো ২৪ ঘণ্টা উৎপাদনে আছে। তারপরও চাহিদার পুরোটা মেটানো সম্ভব হচ্ছে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমস্যার কথা শোনা যাচ্ছে। আমদানি করা স্যালাইন দেশে পৌঁছালে সমস্যা আর থাকবে না।
মো. সালাহউদ্দিন, পরিচালক, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর

খুলনা বিভাগের চিত্র

খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্যালাইন শেষ হয়ে যাওয়ায় ১০ দিনের মতো রোগীদের স্যালাইন সরবরাহ করা বন্ধ ছিল। তবে গত বুধবার তিন হাজার লিটার স্যালাইন বরাদ্দ পেয়েছে হাসপাতালটি। বৃহস্পতিবার থেকে আবার রোগীদের স্যালাইন সরবরাহ করা হচ্ছে।

সাতক্ষীরা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নরমাল স্যালাইনের সংকট নেই। হাসপাতালের স্টোরকিপার হাবিবুর রহমান বলেন, তাঁদের এক মাস চলার মতো নরমাল স্যালাইন রয়েছে।

তবে সাতক্ষীরার নিউমার্কেট মোড়ে অবস্থিত নাহিদ ফার্মেসির মালিক নাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, নরমাল স্যালাইনের সংকট আছে। জুলাইয়ে তাঁদের চাহিদার ৬০ ভাগ সরবরাহ করেছে একটি কোম্পানি।

বাগেরহাট জেলা হাসপাতালে পর্যাপ্ত স্যালাইন না থাকায় ভর্তি রোগীদের অনেককে বাইরে থেকে কিনতে হচ্ছে বেশি দামে। হাসপাতালে ভর্তি দুজন ডেঙ্গু রোগীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, হাসপাতালের সামনের দোকান থেকে তাঁরা স্যালাইন কিনেছেন।

বাগেরহাটে হাসপাতালের পাশাপাশি ওষুধের দোকানগুলোতে সব ধরনের স্যালাইনের স্বল্পতা চলছে দেড় মাসের বেশি সময় ধরে। ওষুধের দোকানিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাজারে সবচেয়ে বেশি চাহিদা কলেরা স্যালাইনের, যা প্রায় তিন মাস ধরে কোম্পানি থেকে সরবরাহ নেই।

যশোর জেনারেল হাসপাতালের বর্তমানে যে পরিমাণ স্যালাইন মজুত রয়েছে, তাতে আর ১০ দিন চালানো যাবে বলে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে। এ ব্যাপারে হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক হারুন অর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ডের জন্য নরমাল স্যালাইনের ঘাটতি রয়েছে।

কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগীর জন্য তিন শতাধিক স্যালাইনের ব্যাগ মজুত রয়েছে বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

জানতে চাইলে অপসো স্যালাইন কোম্পানি লিমিটেডের খুলনার আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক মো. নূরুল ইসলাম খান বলেন, সাধারণ সময়ের চেয়ে নরমাল স্যালাইনের চাহিদা অনেক বেড়েছে। হঠাৎ করে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় সরবরাহ করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

ভারত থেকে স্যালাইন আসছে

চাহিদা মেটাতে সরকার ভারত থেকে স্যালাইন আমদানি করছে। আজ রোববার স্যালাইনের প্রথম চালান যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে দেশে ঢুকবে বলে জানিয়েছেন ইডিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এহসানুল কবির। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘তিন লাখ ব্যাগ স্যালাইন ভারত থেকে আনা হচ্ছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি ট্রাক বেনাপোলে পৌঁছেছে।’

 [প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন চট্টগ্রামের নিজস্ব প্রতিবেদক প্রণব বল, বরিশালের এম জসীম উদ্দীন, খুলনার শেখ আল-এহসান, সাতক্ষীরার কল্যাণ ব্যান্যার্জি, কুষ্টিয়ার তৌহিদী হাসান, যশোর কার্যালয়ের মনিরুল ইসলাম, বাগেরহাট প্রতিনিধি ইনজামামুল হক]