বড় দাগে ঢাকা ওয়াসার দায়িত্ব তিনটি। রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসন, পানি সরবরাহ ও সুয়ারেজ (পয়োনিষ্কাশন) সেবা। এই তিন ক্ষেত্রেই সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান ‘সফল’। বলা যায়, এই ‘সফলতার’ ভিত্তিতেই আরও তিন বছরের জন্য এমডি পদে থাকতে যাচ্ছেন তাকসিম এ খান।
তাকসিম এ খান কতটা সফল, তা ওয়াসার দায়িত্বে থাকা তিনটি দায়িত্বের বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলেই স্পষ্ট হবে। ঢাকায় একটু ভারী বৃষ্টি হলেই এখনো জলাবদ্ধতা হয়। এটি নিরসনের মূল দায়িত্ব ছিল ঢাকা ওয়াসার কাঁধে। শহরের ২৬টি খাল ছিল ঢাকা ওয়াসার দায়িত্বে। রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে সংস্থাটি কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে। কিন্তু ফল কতটা, তা জলাবদ্ধতায় ভুক্তভোগীরা ভালো বলতে পারবেন।
জলাবদ্ধতা নিরসনে ঢাকা ওয়াসা ব্যর্থ হওয়ায় সরকার খালের দায়িত্বই সরিয়ে নেয় সংস্থাটির কাছ থেকে। ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা শহরের জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব (খাল ও ড্রেনেজ) আনুষ্ঠানিকভাবে ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে দুই সিটি করপোরেশনকে হস্তান্তর করা হয়। ড্রেনেজ-ব্যবস্থা হস্তান্তরসংক্রান্ত সমঝোতা স্মারকে ঢাকা ওয়াসার পক্ষে সংস্থাটির এমডি তাকসিম এ খান স্বাক্ষর করেন। মূলত জলাবদ্ধতা নিরসনে চূড়ান্তভাবে ব্যর্থ হওয়াতেই এই দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়।
ওয়াসার আরেকটি দায়িত্ব পয়োনিষ্কাশনসেবা দেওয়া। অথচ রাজধানীর ৮০ শতাংশের বেশি এলাকায় পয়োবর্জ্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থায়ই নেই। ২০০৯ সালে ঢাকা ওয়াসার এমডি পদে প্রথমবারের মতো নিয়োগ পেয়েছিলেন তাকসিম এ খান। এরপর গত ১৪ বছরে রাজধানীতে নতুন এক কিলোমিটার পয়োনিষ্কাশন নালাও নির্মিত হয়নি।
যে এলাকায় ওয়াসার পয়োনালা রয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগই এখন অকেজো। ফলে অধিকাংশ পয়োবর্জ্য কোনো না কোনো পথে খাল ও নদীতে যাচ্ছে। কিন্তু ঢাকা ওয়াসা গ্রাহকদের কাছ থেকে পয়োনিষ্কাশন (সুয়ারেজ) বিল ঠিকই আদায় করছে।
ওয়াসার কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীদের বক্তব্য অনুযায়ী, এই সময়ে কোনো ধরনের সংস্কারকাজ না হওয়ায় ওয়াসার বিদ্যমান পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা পুরো ভেঙে পড়েছে। তাঁদের হিসাবে, গত ১৩ বছরে পয়োনিষ্কাশন বিল বাবদ ঢাকা ওয়াসা গ্রাহকদের কাছ থেকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা আদায় করেছে।
ঢাকা ওয়াসা নিজেদের তৈরি মহাপরিকল্পনাতেই পয়োনিষ্কাশনব্যবস্থা অকার্যকর থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছে। পয়োনিষ্কাশনের জন্য ২০১৩ সালে মহাপরিকল্পনা তৈরি করে ঢাকা ওয়াসা। এতে বলা হয়, পয়োবর্জ্য পরিবহনের প্রধান পাইপলাইন ‘ট্রাঙ্ক সুয়ারস’ নামে পরিচিত। ঢাকা ওয়াসার তিনটি ট্রাঙ্ক সুয়ারস আছে। এই লাইনগুলোর বেশির ভাগ এখন আর কার্যকর নেই। অর্থাৎ গত ১৪ বছরে পয়োনিষ্কাশন খাতেও অগ্রগতি তেমন নেই।
ঢাকা ওয়াসা দাবি করে, রাজধানীতে এখন পানির সংকট নেই। কথায় কিছুটা সত্যতা রয়েছে, তবে এর মধ্যে শুভংকরের ফাঁকিও আছে। গত এক যুগে ভূগর্ভস্থ উৎসের পানি সংগ্রহেই বেশি মনোযোগী ছিল ওয়াসা। এই সময়ে পানির উৎসের টেকসই সমাধান করা যায়নি।
২০১০ সালে ঢাকা ওয়াসার উৎপাদিত পানির ৮০ শতাংশ ছিল ভূগর্ভস্থ উৎসের। আর ২০ শতাংশ ছিল ভূ-উপরিভাগের পানি। তাকসিম এ খান ভূ-উপরিভাগের পানির উৎপাদন অন্তত ৭০ শতাংশে উন্নীত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন। লক্ষ্য অর্জনে তিনি নিজেই ২০২১ সাল পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করেছিলেন। তবে বাস্তবতা ভিন্ন।
গত এক যুগে নতুন করে ৪০৪টি গভীর নলকূপ বসানো হয়েছে। বর্তমানে ওয়াসার সরবরাহ করা পানির ৭০ শতাংশের বেশি ভূগর্ভস্থ উৎসের। এখন ওয়াসার পানি তোলা হয় ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চলে বসানো মোট ৯ শতাধিক গভীর নলকূপের মাধ্যমে। এর ফল হচ্ছে প্রতিবছর পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে, যা প্রকৃতি-পরিবেশের জন্য বড় ঝুঁকি তৈরি করেছে। অর্থাৎ পানি সরবরাহ করতে পারলেও পুরো নগরীকে ঝুঁকির মুখে ফেলছে সংস্থাটি।
এই তিন ক্ষেত্রের বাইরেও তাকসিম এ খানের ‘সফলতা’ কম নয়। ২০০৯ সালে দায়িত্ব নেওয়ার পর পানির দাম বাড়িয়েছেন ১৪ বার। ঢাকা ওয়াসার সাতটি প্রকল্পে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২১ হাজার কোটি টাকা। ঢাকা ওয়াসা দৈনিক যত পানি উৎপাদন করে, সিস্টেম লসের কারণে তার ২০ শতাংশের বেশি গ্রাহক পর্যন্ত পৌঁছায় না। গত এক যুগে বছরে তাকসিম এ খানের মাসিক বেতন বেড়েছে ৪২১ শতাংশ। ঢাকা ওয়াসার এমডি হিসেবে বর্তমানে তাঁর মাসিক বেতন ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা।
এত এত ‘সফলতা’র কারণেই নিশ্চয় তাকসিম এ খান আবার নিয়োগ পাচ্ছেন। দুর্ভাগ্য শুধু নগরীর বাসিন্দাদের। বৃষ্টি হলে তাঁরা জলাবদ্ধতায় ডুবেছেন, পয়োনিষ্কাশনের কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই, দফায় দফায় পানির দাম বাড়লেও টেকসই কোনো উৎস এখনো গড়ে ওঠেনি। এসব ‘ব্যর্থতা’ শুধুই নাগরিকদের।