বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে দলবদ্ধ সহিংসতা ও গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা বেড়ে যাওয়া নিয়ে গভীর উদ্বেগ ও শঙ্কা প্রকাশ করেছে জাস্টিসমেকার্স বাংলাদেশ ইন ফ্রান্স (জেএমবিএফ)। গতকাল রোববার নিজেদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা এক বিবৃতিতে এ উদ্বেগ ও শঙ্কা প্রকাশ করা হয়। প্যারিসভিত্তিক এই মানবাধিকার সংগঠনটি গত জুলাইয়ে বাংলাদেশে ছাত্র–জনতার আন্দোলনে সহিংসতার নিন্দা ও দোষীদের বিচার দাবি করে বিবৃতি দিয়েছিল।
জেএমবিএফের প্রধান সমন্বয়কারী ও নির্বাহী সদস্য মোসা জান্নাতুল ফেরদৌস গতকালের বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেছেন। এতে বলা হয়, গত ৫ আগস্ট সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশত্যাগের পর বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি হয়। এরপর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়।
বাংলাদেশে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সব ধরনের দলবদ্ধ সহিংসতা (মব ভায়োলেন্স) ও গণপিটুনিতে হত্যার (লিঞ্চিং) ঘটনা বন্ধে তাৎক্ষণিক ও সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতি জরুরি ভিত্তিতে আহ্বান জানিয়েছে জেএমবিএফ। একই সঙ্গে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো হাইকোর্টের বিচারকদের নেতৃত্বে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের দিয়ে তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছে তারা। ফ্রান্সভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠনটি বলেছে, ন্যায়বিচার সমুন্নত রাখতে এসব ঘটনার জন্য প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে একটি স্বচ্ছ ট্রাইব্যুনাল প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
জেএমবিএফের বিবৃতিতে বলা হয়, মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের বরাতে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে রাজনৈতিক পালাবদলের পর দলবদ্ধ হামলা ও গণপিটুনিতে হত্যার ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে এই ধরনের ৫৩টি ঘটনায় অন্তত ৪৪ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে শুধু সেপ্টেম্বর মাসে ৩৩টি দলবদ্ধ হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। গুরুতর আহত হয়েছে ২২ জন।
জেএমবিএফের প্রধান উপদেষ্টা ও বিশিষ্ট ফরাসি মানবাধিকারকর্মী রবার্ট সাইমন বাংলাদেশের দলবদ্ধ হামলা ও গণপিটুনিতে হত্যা প্রসঙ্গে বলেন, ‘আইন লঙ্ঘনের ঘটনার এই বৃদ্ধি মৌলিক মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের মূলনীতির স্পষ্ট লঙ্ঘন। হতাশা ও আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়ার কারণে সংঘটিত গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা গণতন্ত্র, আইনের শাসন ও মৌলিক মানবিক মর্যাদার জন্য বড় হুমকি।’
জেএমবিএফের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আইনজীবী শাহানুর ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশ দলবদ্ধ সহিংসতা বৃদ্ধির প্রবণতা একটি ব্যবস্থা ব্যর্থ হওয়ার প্রত্যক্ষ পরিণতি। যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া ও আইনের শাসনের পরিবর্তে দলবদ্ধ হামলা ঘটতে দিলে কোনো সমাজ নিজেদের ন্যায়পরায়ণ ও মানবিক বলে দাবি করতে পারে না। আরও রক্তপাত প্রতিরোধে অবিলম্বে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য আমরা অন্তর্বর্তী সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’
জেএমবিএফ বিশ্বাস করে, এসব সমস্যাজনক প্রবণতা শুধু শাসনের ব্যর্থতার ইঙ্গিত দেয় না, বরং তা রাষ্ট্রের ন্যায়বিচার নিশ্চিতের সক্ষমতার ওপর জনগণের আস্থা গুরুতর কমে যাওয়াকে নির্দেশ করে। সব নাগরিককে রক্ষা করা, জনগণের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনা এবং কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হবে না, এসব নিশ্চিত করা অন্তর্বর্তী সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর দায়িত্ব। দলবদ্ধ সহিংসতার মাধ্যমে ন্যায়বিচার করা যায় না এবং তা কোনোভাবেই করা যাবে না।
জেএমবিএফের বিবৃতিতে জোর দিয়ে বলা হয়, ‘বাংলাদেশে সম্প্রতি গণপিটুনিতে হত্যার ঘটনা বাড়ার বিষয়টি আইনি প্রতিষ্ঠানগুলো দ্রুত শক্তিশালী করার ও মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। একটি সভ্য সমাজে সহিংসতা ও অরাজকতার কোনো স্থান নেই। অন্তর্বর্তী সরকারকে আইনের শাসন নিশ্চিত করতে হবে। এই সব ভয়াবহ হামলায় ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতি সংহতি জানিয়ে আমরা অবিলম্বে ন্যায়বিচার এবং দায়ীদের জবাবদিহির আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।’
এসব সহিংসতা রোধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষগুলোর প্রতি জোর তাগিদ দিয়েছে জেএমবিএফ। সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, ‘আমরা এসব জঘন্য অপরাধের সঙ্গে জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করার আহ্বান জানাই এবং গণপিটুনিতে হত্যা বন্ধে সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাই।’
বিবৃতির শেষে বলা হয়, জাস্টিসমেকার্স বাংলাদেশ ইন ফ্রান্স (জেএমবিএফ) ভুক্তভোগীদের অধিকার, সরকারের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে কাজ অব্যাহত রাখবে। এ ছাড়া আরও বলা হয়, ‘আমরা এমন এক বাংলাদেশের জন্য কাজ করে যাব, যেখানে সহিংসতা নয়, আইনি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হবে।’