ঢাকায় সন্তান জন্মে উচ্চ ব্যয়, ঋণগ্রস্ত বাবা–মা

অস্ত্রোপচারে সন্তান জন্ম হলে ঋণ করতে হয় নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোকে। শহর এলাকায় অস্ত্রোপচারে জন্ম হচ্ছে প্রায় ৬০ শতাংশ শিশু।

মামুন শিকদার গ্রিল কারখানায় কাজ করেন। আসন্ন সন্তান প্রসবা স্ত্রীর জন্য তিনি কম খরচে ভালো হাসপাতাল খুঁজছিলেন। ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার একটি বেসরকারি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁকে ভয় দেখিয়ে বলে, সন্তান বিকলাঙ্গ হতে পারে। ভয় পেয়ে তিনি ঢাকার একটি হাসপাতালে আসেন। চিকিৎসক জানান, বড় কোনো স্বাস্থ্যঝুঁকি নেই। তবে সন্তান নিরাপদে জন্মালেও খরচ হয়েই যায়।

খরচ বেড়ে যাওয়ার কারণ অস্ত্রোপচার। যা সি সেকশন, অর্থাৎ সিজারিয়ান ডেলিভারি নামে পরিচিত। জটিলতার ভয়ে মামুনের পরিবারই সিজার করানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

ছেলে হইছে, আমি বহুত খুশি। তয় এত টাকাপয়সা দেওয়ার তো সামর্থ্য নাই। কিছু টাকা জমাই রাখছিলাম। বাকি টাকা ধারদেনা করতে হইছে।
মামুন শিকদার, গ্রিল কারখানায় শ্রমিক

হাসপাতালের খরচ বাবদ ইতিমধ্যে প্রায় ৩০ হাজার টাকা পরিশোধ করেছেন তিনি। অস্ত্রোপচারের প্যাকেজ ১৩ হাজার টাকা হলেও নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র (আইসিইউ) ও কিছু পরীক্ষা–নিরীক্ষার ব্যয় মিলিয়ে এই অঙ্কে পৌঁছেছে। ওষুধের আলাদা খরচ তো আছেই। হাসপাতালটির ফ্রি বেডের সুবিধা নেওয়া মামুন বলেন, ‘ছেলে হইছে, আমি বহুত খুশি। তয় এত টাকাপয়সা দেওয়ার তো সামর্থ্য নাই। কিছু টাকা জমাই রাখছিলাম। বাকি টাকা ধারদেনা করতে হইছে।’

শুধু মামুন নয়, অস্ত্রোপচারের কারণে সমাজের সব শ্রেণির মানুষের সন্তান জন্মের ব্যয়ই বাড়ছে। অবস্থাভেদে এ খরচ কয়েক হাজার থেকে লাফিয়ে ওঠে কয়েক লাখেও। স্বাভাবিক প্রসবে খরচ থাকলেও তা অনেক কম। তবু অপ্রয়োজনীয় অস্ত্রোপচার ও খরচ—দুটোই বাড়ছে।

অতিরিক্ত খরচ হলেও অস্ত্রোপচারে শিশু জন্মের হার কমছে না। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকসের (এসভিআরএস ২০২৩) তথ্য অনুযায়ী, দেশের শহর এলাকায় অস্ত্রোপচারে প্রায় ৬০ শতাংশ শিশুর জন্ম হচ্ছে। ২০২১ সালের চেয়ে এ হার ৬ শতাংশ পয়েন্ট বেশি। সর্বশেষ জনমিতি ও স্বাস্থ্য জরিপ প্রতিবেদন ২০২২-এ বলা হয়েছে, গত এক যুগে দেশে অস্ত্রোপচারে শিশু জন্মের হার বেড়েছে ২৭ শতাংশ।

২০২২ সালে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণাপ্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) সি সেকশন নিয়ে এক গবেষণা প্রতিবেদনে জানায়, দেশে দ্রুত হারে বাড়ছে অস্ত্রোপচারে শিশুর জন্ম। এর মধ্যে বেশির ভাগ সি সেকশন হচ্ছে অপ্রয়োজনীয়। হাসপাতালে স্বাভাবিক প্রসবে যা খরচ হচ্ছে, তার চেয়ে চার গুণ বেশি খরচ হচ্ছে সি সেকশনে।

রাজধানীর বেশ কিছু বেসরকারি হাসপাতাল ঘুরে দেখা যায়, প্রসূতিসেবা ক্লিনিক ও ছোট হাসপাতালগুলোয় অস্ত্রোপচার করা যায় ১২ থেকে ২০ হাজার টাকায়। স্বাভাবিক প্রসবে খরচ হয় ৪ থেকে ৮ হাজার টাকা।

হাসপাতালের প্রস্তাবিত প্যাকেজেই মামুনের মতো পরিবার সেবা নেয়। তবে প্যাকেজের বাইরের খরচেই বেড়ে যায় ব্যয়। অথচ সরকারি হাসপাতালে তেমন খরচ নেই। শুধু কিনে আনতে হয় চিকিৎসক নির্দেশিত ওষুধপত্র। জটিলতা না থাকলে স্বাভাবিক প্রসব ২০০-৫০০ টাকা এবং অস্ত্রোপচার সর্বোচ্চ ৩ হাজার টাকার মধ্যে হয়ে যায়।

মিরপুরে একটি হাসপাতালের বাইরে একজন নারীর সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। কম খরচ সত্ত্বেও তিনি সরকারি হাসপাতালে যাননি কেন? নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘বেসরকারি হাসপাতালের মতো সেবা তো সরকারিতে দেয় না। সিট পাওয়াও সহজ নয়। ঝামেলা এড়াতে বাড়তি টাকা লাগলেও মানুষ বেসরকারিতে আসে।’

পরিসংখ্যান বলছে, শিশু জন্মে বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে যায় দেশের ৩৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ মানুষ, যা এর আগের বছরে ছিল প্রায় ৩৩ শতাংশ।

প্যাকেজ নিয়ে জটিলতা

হাসপাতালের প্যাকেজবহির্ভূত খরচ নিয়ে মিরপুরের ওই নারীর বক্তব্য, ‘শুরুতে বলছিল ১৪ হাজারে অস্ত্রোপচারসহ সব হবে। কিন্তু ভর্তি হওয়ার পর টেস্টের খরচ, ওষুধের খরচ দিতেই তো অবস্থা খারাপ। এসব হিসাব আগেভাগে খোলাসা করে বলে দিলেই ভালো হয়।’

শিশু জন্মে বিভিন্ন প্যাকেজ নির্ধারণ করা থাকে। এসি/নন–এসি কেবিন, সাধারণ ওয়ার্ড, সেবা পাওয়ার ধরন ইত্যাদি বিষয়ের ওপর এসব প্যাকেজের খরচ নির্ভর করে। কিছু হাসপাতালে চিকিৎসকই রোগীর সঙ্গে কথা বলে এই হিসাব ঠিক করেন। কিন্তু প্যাকেজের খরচই শেষ নয়।

বেসরকারি হাসপাতালে সন্তান জন্মের খরচের ঊর্ধ্বসীমা নেই। সম্প্রতি ঢাকার একটি প্রথম সারির হাসপাতালে মেয়ের জন্ম খরচ বাবদ প্রায় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা ব্যয় করেছে একটি পরিবার।

মৃত সন্তান জন্মেও খরচ হয়েছে প্রায় দেড় লাখ

হাসপাতালে বিমর্ষ চেহারায় বসে ছিলেন মো. জাফর। তিনি তাঁর গর্ভবতী মেয়েকে একটি হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলেন। অস্ত্রোপচারের পর চিকিৎসকের কাছে জানতে পারেন, এক দিন আগে গর্ভেই শিশুর মৃত্যু ঘটেছে। তবু হাসপাতালের খরচ হিসেবে গুনতে হয়েছে প্রায় ৮০ হাজার টাকা।

পেশায় রাজমিস্ত্রি জাফর বলেন, ‘ওখানে ওই ঘটনা হওয়ার পর মেয়েও কেমন জানি করতেছিল। ওরে বাঁচাইতে এই হাসপাতালে আনছি। দুই দিন আইসিইউতে থাইকা এখন মোটামুটি সুস্থ হইছে।’

এখানেও খরচ হয়েছে প্রায় ৬৫ হাজার টাকা। আত্মীয়স্বজনের কাছে ধার নিয়ে আপাতত পরিস্থিতি সামলেছেন। কিন্তু কীভাবে এত টাকার ধার শোধ করবেন, সেটিই এখন তাঁর চিন্তার বিষয়।

খরচ নগণ্য, কিন্তু...

ঢাকার কড়াইল বস্তি এলাকায় থাকেন নাসিমা বানু (ছদ্মনাম)। সন্তান গর্ভে আসার আগে রেস্টুরেন্টে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজ করতেন। সন্তানের বয়স ১০ মাস ছুঁই ছুঁই। ওকে নানির কাছে রেখে আবারও আগের কাজ খুঁজতে বের হয়েছেন। নাসিমা বলেন, ‘আমাগো তো হাসপাতালের এত খরচ দেওয়া সম্ভব না। আমার মা দাইমা নিয়ে আইছিল। সে বাবু প্রসব করাইছে। কোনো সমস্যা হয় নাই। তারে শাড়ি, তেল, সাবান কিন্না দিছি আর হাতে এক হাজার টাকা। ইনজেকশন, ওষুধে দুই-তিন হাজার টাকা লাগছে। মাইয়া হইতে এইটুকুই খরচ।’

সরকারি হাসপাতালের কথা জিজ্ঞাসা করায় তিনি আলো ক্লিনিকের কথা বললেন। কড়াইল বস্তিবাসীর জন্য কাজ করা এই ক্লিনিকে তিনি গর্ভবতী থাকা অবস্থায় তিনবার স্বাস্থ্য পরীক্ষা করিয়েছেন। সেখানকার চিকিৎসকেও স্বাভাবিক প্রসবের কথাই বলেছিলেন। এই ক্লিনিকে বিনা মূল্যে সব সেবা ও ওষুধ পাওয়া যায়। তাই এলাকার উল্লেখযোগ্যসংখ্যক প্রসূতি নারীরা সেখানে সেবা নেন।

বাসায় প্রসব সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ত্রীরোগবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. নার্গিস আক্তার বলেন, গর্ভবতী মায়ের শারীরিক অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হলে এবং প্রথম সন্তানের ক্ষেত্রে বাসায় প্রসবে কোনো সমস্যা নেই। তবে তা চিকিৎসক ও প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মীর পরামর্শে হতে হবে। দাইমারও প্রশিক্ষণ থাকা জরুরি। কিন্তু প্রসববেদনা ওঠার ১২ ঘণ্টার মধ্যেও প্রসব না হলে অবশ্যই স্বাস্থ্যকেন্দ্র বা হাসপাতালে নিতে হবে। তিনি বলেন, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, আগে অস্ত্রোপচার করা হয়েছে—এ রকম ইতিহাস থাকলে হাসপাতালে আসাই নিরাপদ।

বিশেষজ্ঞ যা বলছেন

স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সংগঠন অবসটেট্রিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. ফেরদৌসী বেগম বলছেন, সিজারিয়ান মূলত জটিল পরিস্থিতিতে মা ও সন্তানের জীবন বাঁচানোর প্রক্রিয়া। প্রসবের একটা অংশ সিজারিয়ান করে করতেই হয়। অস্ত্রোপচার যেমন বেড়েছে, মাতৃমৃত্যুর হারও তো অনেক কমেছে। এ ছাড়া হাইপারটেনশন, ডায়াবেটিসসহ নানা কারণে শারীরিক জটিলতাও আগের থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে। এটাও অস্ত্রোপচার বাড়ার একটা কারণ।

এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ১০-১৫ শতাংশ প্রসবে অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হয়। অথচ শহরে এর অন্তত চার গুণ বেশি হচ্ছে।

অধ্যাপক ফেরদৌসীর মতে, চিকিৎসকেরা স্বাভাবিক প্রসবেই উৎসাহিত করে থাকেন। পরিস্থিতি বিবেচনায় অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেওয়া হয়। কিন্তু অনেক সময় রোগীও অস্ত্রোপচার করতে জোর করেন। স্বাভাবিক প্রসববেদনার ভয়েও অনেকে এটা করতে চান। কিন্তু অন্য সব সার্জারির মতো এ ক্ষেত্রেও অতিরিক্ত জটিলতার সৃষ্টি হতে পারে।

জটিলতার সঙ্গে বাড়তি খরচের বোঝা তো আছেই, যা মামুন শিকদারসহ অনেকেই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।