দেশীয়ভাবে মেরামতের ১৫ দিনেই এক ইঞ্জিন নষ্ট, উঠছে না জ্বালানি খরচ

পার্বতীপুর-রংপুর পথে চলাচলকারী ডেমু ট্রেনের উদ্বোধন করা হয় ঘটা করে। ১৫ দিনের মধ্যেই ট্রেনের একটি ইঞ্জিন বিকল হয়
ফাইল ছবি

দেশীয় পদ্ধতিতে, সাশ্রয়ী মূল্যে অচল ডেমু ট্রেন মেরামত করে সচল করছে বলছে রেলওয়ে। রেলমন্ত্রীকে দিয়ে সচল করা একটি ডেমু ট্রেনের আনুষ্ঠানিক চলাচলও উদ্বোধন করা হয়েছে। কিন্তু ১৫ দিনের মাথায় ওই ডেমু ট্রেনের দুটি ইঞ্জিনের একটি বিকল হয়ে পড়েছে। এখন একটি ইঞ্জিন দিয়ে কোনোরকমে ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার গতিতে ডেমু চালানো হচ্ছে।

ফলে ডেমু ট্রেন সময় মেনে চলতে পারছে না। এতে যাত্রী ও আয় কোনোটাই আশানুরূপ হচ্ছে না। রেলওয়ে সূত্র বলছে ট্রেনটি চালিয়ে গড়ে যে আয় হচ্ছে, তাতে জ্বালানি খরচই উঠছে না।

অচল ডেমু ট্রেন সচল করতে মো. আসাদুজ্জামান নামে এক প্রকৌশলীকে দায়িত্ব দেয় রেলওয়ের মেকানিক্যাল বিভাগ। তিনি বিভিন্ন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের হয়ে চাকরি করেন। গত ২ বছর ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা খরচ করে এক সেট ডেমু ট্রেন সচল করা হয়।
গত ৯ অক্টোবর রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন দিনাজপুরের পার্বতীপুর থেকে রংপুর পর্যন্ত পথে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ট্রেনের চলাচল উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে মন্ত্রীসহ কর্মকর্তারা বলেছিলেন, ডেমু ট্রেনটি ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটার গতিতে চালানো হচ্ছে।

রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, উদ্বোধনের পর কিছুদিন ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার গতিতে ডেমু ট্রেন চলেছে। গত ২৫ অক্টোবর একটি ইঞ্জিন বিকল হয়ে যায়। এখনো সেটি বিকল আছে। ডেমু ট্রেনের দুই পাশে দুটি ইঞ্জিন। এখন একটি ইঞ্জিন দিয়েই চলছে। গতি ঘণ্টায় ২০ থেকে ২৫ কিলোমিটার। ট্রেনটি দিনে একবার রংপুর গিয়ে পুনরায় পার্বতীপুরে ফিরে আসে। অর্থাৎ দিনে দুইবার চলাচল করে।

রেলওয়ে সূত্র আরও বলেছে, ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত ডেমু ট্রেনটি মোটামুটি সময় মেনেই চলাচল করেছে। একটি ইঞ্জিন বিকল হওয়ার পর ২৫ অক্টোবর পার্বতীপুর থেকে ৫৫ মিনিট দেরিতে ছাড়ে। রংপুর পৌঁছে ফেরার সময় এক ঘণ্টার বেশি দেরি করে। এরপর প্রতিদিনই আসা-যাওয়ায় এক ঘণ্টা বা তারও বেশি দেরি করছে। ডেমু ট্রেনটির যাত্রী মূলত স্বল্প দূরত্বের। তাদের বেশির ভাগই অফিসগামী। কেউ কেউ জরুরি কাজে যাতায়াত করেন। সময় মেনে চলছে না বলেও যাত্রী পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে ট্রেনটি থেকে যে আয় হচ্ছে, তা দিয়ে জ্বালানি খরচই উঠছে না।

ট্রেনটি চালিয়ে ব্যয় উঠছে না

রেলওয়ের পশ্চিমাঞ্চলের সূত্র থেকে ৯ অক্টোবর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত ট্রেনটির যাত্রী ও আয়ের তথ্য পাওয়া গেছে। এতে দেখা গেছে, ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত পার্বতীপুর থেকে রংপুর যাওয়ার পথে দিনে তিন বগির ট্রেনটিতে মাত্র ১ হাজার ৮১৫ জন যাত্রী পরিবহন করেছে। অথচ ট্রেনটিতে বসার জন্য ১৫০টি আসন রয়েছে। আর দাঁড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে আরও সমসংখ্যক যাত্রীর। যাত্রী যাতায়াতের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ সময়ের মধ্যে সর্বনিম্ন  ১৫ জন যাত্রী নিয়েও চলেছে ট্রেনটি। বেশির ভাগ দিনই চলেছে ৫০ জনের কম যাত্রী নিয়ে। ১ দিন শুধু সর্বোচ্চ ২০১ জন যাত্রী যাতায়াত করেছে।

অন্যদিকে রংপুর থেকে পার্বতীপুর যাওয়ার বেলায় যাত্রী কিছুটা বেশি ছিল। এই পথে যাত্রী যাতায়াত করেছে ৬ হাজার ৬০২ জন। এর মধ্যে সর্বনিম্ন ৩৮ জন এবং সর্বোচ্চ ২৩২ জন যাত্রী যাতায়াত করেছে। এই ট্রেন চলছে রেলের লালমনিরহাট বিভাগের অধীনে। এই বিভাগে অন্য পথে রেলের লোকাল বা মেইল ট্রেনগুলোতে এর চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী যাতায়াত করে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
রেলওয়ে সূত্রে জানা গেছে, পার্বতীপুর-রংপুর পথে ডেমু ট্রেনটি চালিয়ে আয় হয়েছে ৩৫ হাজার ৭২৮ টাকা। অন্যদিকে রংপুর-পার্বতীপুর পথে আয় হয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৭২৮ টাকা। অর্থাৎ ৫৩ দিনের আসা-যাওয়ায় আয় হয়েছে মোট ১ লাখ ৭১ হাজার ৪৫৬ টাকা। প্রতিদিন গড়ে আয় ৩ হাজার ২৩৫ টাকার মতো।

রেলওয়ের ডেমু পরিচালনায় যুক্ত একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ডেমু ট্রেনটির যাওয়া এবং আসায় কম হলেও ৭০ লিটার ডিজেল খরচ হয়। প্রতি লিটার ডিজেলের মূল্য ১০৯ টাকা। সে হিসাবে দিনে জ্বালানির পেছনে ব্যয় দাঁড়ায় ৭ হাজার ৬৩০ টাকা। এর সঙ্গে রেললাইন ব্যবহার, চালক ও কর্মচারীর বেতন, লাইন ব্যবহারের খরচ, দৈনন্দিন মেরামত হিসেবে নিলে ট্রেনটি চালিয়ে খরচের তিন ভাগের এক ভাগও উঠছে না।

মেরামতের পর আবার অচল

২০ সেট ডেমু ট্রেন কিনতে সরকারের ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। এতে যাত্রী পরিবহন করে আয় হয়েছে ২২ কোটি টাকার মতো। মেরামত ও জ্বালানির পেছনে আবার খরচ হয়েছে প্রায় ৩০ কোটি টাকা। ফলে দেখা যাচ্ছে, জনগণের বিপুল অঙ্কের টাকা গচ্চা যাচ্ছে ডেমু ট্রেনের পেছনে। বারবার মেরামতের পরও অচল হয়ে পড়েছে ডেমু ট্রেন।

এরই ধারাবাহিকতায় দেশীয় প্রযুক্তিতে একটি ডেমু মেরামত করার পর সব কটি ট্রেন মেরামতের উদ্যোগ নেয় রেলের মেকানিক্যাল বিভাগ। এ লক্ষ্যে ২০ অক্টোবর ঢাকার রেলভবনে মেকানিক্যাল বিভাগ ও ডেমু সচল করার দায়িত্ব দেওয়া প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান একটি পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনা করেন। এ সময় রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম, মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. হুমায়ুন কবীর, রেলের মহাপরিচালক ডি এন মজুমদারসহ সংস্থাটির শীর্ষ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। এ সময় জানানো হয় প্রতি সেট ডেমু ট্রেন সচল করতে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা খরচ হবে। এতে ২০ সেট ডেমুর পেছনে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা খরচ হবে। দরপত্র ছাড়াই দ্রুত ডেমু মেরামতের অনুমতি দেওয়ার জন্য রেলমন্ত্রীর কাছে আবেদন করে মেকানিক্যাল বিভাগ। পরে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, একটি কমিটি মেরামতে কত ব্যয় হতে পারে একটা ধারণা তৈরি করবে। আর রেলসচিব মনে করেন, মেরামতে উন্মুক্ত দরপত্র বা সরকারি বিধান মেনে করা দরকার।

রেলের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ঠিকাদার ও রেলের মেকানিক্যাল বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা মিলে ডেমু ট্রেন মেরামতের বিষয়টি দ্রুত অনুমোদন দিতে চাপ দিচ্ছে। তবে এভাবে মেরামত করলে ডেমু চলবে কিনা এর কোনো নিশ্চয়তা দিতে রাজি নয়। কিন্তু মেরামতের পর ছয় মাস ঠিকঠাক চলাচল না করলে পুনরায় অর্থ ব৵য় করার কোনো মানে হয় না। মেরামতের পর পার্বতীপুর-রংপুর পথে ডেমু চালুর পর একটি ইঞ্জিন বিকল হওয়া এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, এখন বলা হচ্ছে প্রতি সেট ডেমু মেরামতে ৫০ থেকে ৬০ লাখ টাকা লাগবে। কিন্তু পরে ব্যয় এক কোটি বা এরও বেশি দেখালে কী করার আছে?
রেলের পশ্চিমাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক (জিএম) অসীম কুমার তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, মেরামতের বিষয়টি মেকানিক্যাল বিভাগ বলতে পারবে। তবে ট্রেনে যাত্রী কম হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, এখন পরীক্ষামূলকভাবে ৫০ কিলোমিটারের মধ্যে চলাচল হচ্ছে। এটিকে লালমনিরহাট পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা আছে। তখন যাত্রী অনেক বেড়ে যাবে। আয়ও বাড়বে।