পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা বলেছেন, পুলিশ জনগণের সেবকের পরিবর্তে নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সেবক হয়ে গেছে। পুলিশের সবকিছু ভেঙে পড়েছে। এ জন্য পুলিশে সংস্কার জরুরি।
শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে পুলিশ সংস্কারসংক্রান্ত এক মুক্ত আলোচনায় এসব কথা বলেন নুরুল হুদা। স্বেচ্ছাসেবী মানবাধিকার সংগঠন ‘হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশন’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। আলোচনার বিষয় ছিল—‘৫৩ বছরেও পুলিশ কেন জনবান্ধব হতে পারেনি: পুলিশ সংস্কার, কেন? কোন পথে?’।
আলোচনায় অংশ নিয়ে সাবেক এই আইজিপি বলেন, ‘পলিটিক্যাল ভিশন (রাজনৈতিক লক্ষ্য) না থাকলে কোনো সংস্কারই কার্যকর হবে না। জনগণকে সম্পৃক্ত করে পুলিশিং করলে বড় সংখ্যক পুলিশের প্রয়োজন হবে না। এ ছাড়া অন্য বাহিনী থেকে পুলিশের কোনো ইউনিটে কাউকে আনলে তাঁকে অন্তত ছয় মাস পুলিশিংয়ের প্রশিক্ষণ দিতে হবে।’
এ সময় পুলিশ সংস্কার কমিশনের সদস্য গোলাম রসুল বলেন, বিসিএসের বাইরে পুলিশের আলাদা কমিশন করা যায় কি না, তা দেখতে হবে। প্রযুক্তিনির্ভর ফরেনসিক কার্যক্রম চালু করতে হবে। পুলিশের বিষয়ে তদন্ত করতে আলাদা সাব–কমিশন লাগবে।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী তারেক রিজভী। তিনি বলেন, পুলিশ প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হওয়ার পরিবর্তে সরকার তথা রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষের অংশ হওয়ায় ক্ষমতাসীন সরকারের সঙ্গে পুলিশও জনরোষের শিকার হয়। পুলিশ সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্য (রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও জনমত) থাকা বাঞ্ছনীয়। পুলিশের যত প্রকারের সংস্কারের প্রস্তাব করা হোক না কেন, ঐকমত্য ছাড়া তা বাস্তবায়ন বা কার্যকর হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ।
সুপ্রিম কোর্টের সাবেক রেজিস্ট্রার ও সাবেক জেলা জজ ইকতেদার আহমেদ বলেন, ‘অতীতে অনেক কমিশন হলেও সেগুলো আলোর মুখ দেখেনি। আমাদের তিনটি আইনে পুলিশের ব্যাখ্যা ভিন্ন ভিন্ন। পুলিশ ও আদালতের পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত বিষয়গুলোও সংস্কারের মধ্যে আনতে হবে।’
আলোচনায় যোগ দিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘পুলিশ একা নয়, আসলে আমরা সবাই ফেইল (ব্যর্থ) করেছি। নষ্ট লোকদের খুঁজে খুঁজে গত ১৬ বছর পদায়ন করা হতো। আমাদের দেখতে হবে, সংস্কারের বিষয়ে আমরা উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়ে যাচ্ছি কি না। আর এ সংস্কার রাজনীতিকেরা অ্যালাউ (গ্রহণ) করে কি না।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি মাজহারুল হক বলেন, ‘গত ১৬ বছর আমাদের পুলিশ এমনভাবে অ্যাক্ট (কাজ) করেছে, যা সিনেমাতেও নেই। র্যাম্বো সিনেমাতেও নেই।’
সাবেক ডিআইজি মেসবাহুন নবী বলেন, ‘আমরা গত ৫৩ বছরে ভালো শাসক পাইনি, তাই ভালো পুলিশ পাইনি। এবার সুযোগ এসেছে। একে কাজে লাগাতে হবে। শুধু পুলিশ একা নয়, জাস্টিস সিস্টেমকেও (বিচারপদ্ধতি) বদলাতে হবে। পুলিশে যখন অন্য বাহিনীর লোকেরা এসেছে, তখন থেকেই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড শুরু হয়।’
এ সময় সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজ ইয়াসমিন গফুর বলেন, পুলিশের কর্মঘণ্টা ঠিক করা হয়নি। আইনে পুলিশ বাহিনী বলা হয়েছে। পুলিশ সার্ভিস বলা হয়নি। কমান্ডার কেমন, তার ওপরও নির্ভর করে কেমন পুলিশ হবে।
মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন ‘হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের’ চেয়ারম্যান মুহাম্মদ শফিকুর রহমান। আরও বক্তব্য দেন গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির উপাচার্য আনিসুজ্জামান, হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা মনির হোসাইন কাসেমী, ফ্রন্ট পেজ সম্পাদক সেলিম খান, সাংবাদিক আহমেদ সেলিম রেজা, আইনের শিক্ষক আহমেদুজ্জামান, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের নেত্রী জাকিয়া শিশির, হিউম্যানিটি ফাউন্ডেশনের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মো. পারভেজ, তরুণ প্রতিনিধি সাইদ আবদুল্লাহ ও সাবেক পুলিশ কনস্টেবল মান্নান প্রমুখ।