জাপানি দুই শিশু কেন মায়ের হেফাজতে, আদালতের পর্যবেক্ষণে যা বলা হয়েছে

এরিকো-ইমরান দম্পতি ও তাঁদের শিশুসন্তানেরা
ফাইল ছবি

জাপান থেকে নিয়ে আসা দুই শিশুর অভিভাবকত্ব চেয়ে বাবা ইমরান শরীফের করা মামলা খারিজ করেছেন আদালত। ঢাকার দ্বিতীয় পারিবারিক আদালতের বিচারক দুরদানা রহমান আজ রোববার এ রায় দেন।

রায়ে আদালত বলেছেন, মামলা করার কারণ আদালতের কাছে প্রমাণ করতে পারেনি বাদীপক্ষ। বরং আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে, জাপান থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসা দুই শিশুর বেড়ে ওঠা জাপানে। সেখানে তারা লেখাপড়া করেছে। তাদের মা নাকানো এরিকো পেশায় একজন চিকিৎসক। তিনটি সন্তান জন্মের পর মাতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে সন্তানদের পাশে ছিলেন।

রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, জাপানে বেড়ে ওঠা দুই শিশুর প্রাথমিক শুশ্রূষাকারী তাদের মা নাকানো এরিকো। অথচ তাঁকে কিছু না জানিয়ে সম্পূর্ণ অন্ধকারে রেখে আইনগত প্রক্রিয়া ছাড়া হঠাৎ অন্য একটি দেশে নিয়ে আসাটা মাতৃত্বের বিশ্বজনীন ও সর্বজনীন রূপটিকে অসম্মান করার নামান্তর।

রায়ে আদালত আরও বলেছেন, পিতা হিসেবে ইমরান শরীফ নাবালিকা দুই সন্তানের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করার পূর্ণ হকদার। তবে জাপানি মায়ের কাছে দুই নাবালিকার হেফাজত তাঁদের শারীরিক, মানসিক ও পারিপার্শ্বিক, তথা সার্বিক মঙ্গলজনক বলে আদালতের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে।

আদালতে রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন শিশু দুটির মা নাকানো এরিকো। তাঁর আইনজীবী শিশির মনির প্রথম আলোকে বলেন, আদালত বাবার করা মামলা খারিজ করে দেওয়ায় দুই শিশু মায়ের হেফাজতে থাকবে। অন্যদিকে ইমরান শরীফের আইনজীবী নাসিমা আক্তার বলেছেন, এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আবেদন করা হবে। এই আদালত থেকে তাঁর মক্কেল ন্যায়বিচার পাননি।

জাপান থেকে আসা দুই শিশুর হেফাজত ও অভিভাবকত্ব চেয়ে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকার পারিবারিক আদালতে মামলা করেন ইমরান শরীফ। মামলায় বাদীপক্ষের তিনজন আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছেন। আর বিবাদীপক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছেন জাপানি মা এরিকো। আদালত সাক্ষ্য গ্রহণ ও দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক শুনে আজ রোববার এই রায় ঘোষণা করেন।

বাবার মামলা খারিজ যে কারণে

মামলার কাগজপত্রের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, জাপানি নারী নাকানো এরিকো ও ইমরান শরীফ দম্পতির বিয়ে, জাপানে তাঁদের তিন কন্যাসন্তানের জন্ম, তাঁদের কর্মজীবন, সংসারজীবনের নানা তথ্য উঠে এসেছে এই মামলায়। রায়ে আদালত বলেছেন, জাপান থেকে আসা দুই শিশুর মা-বাবা দুজনই বলেছেন, জাপানে থাকার সময় দুই নাবালিকা শিশু পড়াশোনায় খুব মেধাবী ছিল। তাদের ফল খুব ভালো ছিল। তাদের বাবা দাবি করেন, এ দেশে আনার পর দুই শিশুকে একটা প্রি-ক্যাডেট স্কুলে ভর্তি করান। একই সঙ্গে তারা অনলাইনে আমেরিকার একটি স্কুলে পড়াশোনা করছিল। আদালত বলেন, জাপানে পড়াশোনা করা দুই মেধাবী শিশুকে বাবার একান্ত চিন্তাভাবনা অনুযায়ী নিরবচ্ছিন্ন শিক্ষাপ্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত সমীচীন নয়।

আদালত রায়ে আরও বলেছেন, জাপানের টোকিও পারিবারিক আদালতে একই বিষয়ে মামলা চলা অবস্থায় মায়ের সম্মতি ছাড়া বাবা দুই শিশুকে এ দেশে নিয়ে আসেন। একই বিষয়ে জাপানে বিচারাধীন মামলার তথ্য লুকিয়ে একই বিষয়ে মামলা করার সাধারণ যৌক্তিক চিন্তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আর বিষয়টি নাবালিকা কন্যাদের মানসিক বিকাশের স্বার্থে নিঃসন্দেহে মারাত্মক ও অনুসরণ অযোগ্য কাজ বলে প্রতীয়মান হয়।

রায়ে এই দম্পতির দুই মেয়ের মতামত তুলে ধরেছেন আদালত। বড় মেয়ে স্পষ্ট বলেছে, তার জন্ম বেড়ে ওঠা জাপানে। বাবার বিরুদ্ধে তার কোনো অভিযোগ নেই। তবে আমেরিকায় নিয়ে যাওয়ার কথা বলে তাদের নিয়ে আসা হয় বাংলাদেশে। তার স্কুলের সব বন্ধু জাপানে থাকে। সে জাপানে যেতে চায়। রায়ে আদালত বলেছেন, জাপান ছেড়ে আসার আগপর্যন্ত তিন বোন একসঙ্গে ছিল। তারা এখনো বিচ্ছিন্ন হতে চায় না। সে ক্ষেত্রে অভ্যাসগত বসবাসের জায়গা থেকেও তিন বোনকে বিচ্ছিন্ন করা তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে মঙ্গলজনক হবে না বলে প্রতীয়মান হয়।

এ প্রসঙ্গে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত তুলে ধরে আদালত বলেন, নাবালক-নাবালিকার হেফাজত ঠিক করার ক্ষেত্রে তাদের সর্বাঙ্গীন মঙ্গল বা কল্যাণের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। এই দম্পতির সব ধরনের তথ্য পর্যালোচনা করে রায়ে আদালত বলেছেন, সাধারণ অন্য দশটা মায়ের মতো জাপানি মা তাঁর সন্তানদের দেখভাল করেন। বাবা বাসায় থাকা সাপেক্ষে স্ত্রীকে সহযোগিতা করতেন। তবে নাবালিকা কন্যাদের প্রাথমিক যত্নকারী হিসেবে জাপানি মায়ের তুলনায় বাবার কাছে তাদের হেফাজত অধিকতর কল্যাণকর, তা প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছেন বাদী।

জাপানের নাগরিক এরিকো ও বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ইমরানের ২০০৮ সালের ১১ জুলাই বিয়ে হয়। তাঁদের তিনটি কন্যাসন্তান আছে। ২০২১ সালের ১৮ জানুয়ারি এরিকোর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের আবেদন করেন ইমরান। এরপর ওই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি দুই মেয়েকে (বড় ও মেজ) নিয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন তিনি। ছোট মেয়ে জাপানে আছে।

ইমরানের কাছ থেকে দুই মেয়েকে ফিরে পেতে ঢাকায় এসে ২০২১ সালের ১৯ আগস্ট হাইকোর্টে একটি রিট করেন নাকানো এরিকো। অন্যদিকে ছোট মেয়েকে ফিরে পেতে পৃথক একটি রিট আবেদন করেন ইমরান। পৃথক রিটের ওপর শুনানি নিয়ে দুই শিশু তাদের বাবা ইমরানের হেফাজতে থাকবে বলে ওই বছরের ২১ নভেম্বর হাইকোর্ট আদেশ দেন। এ আদেশ স্থগিত চেয়ে আপিল বিভাগে আবেদন করেন এরিকো; যা চেম্বার আদালত হয়ে আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির জন্য ওঠে।

এরিকোর করা আবেদন (লিভ টু আপিল) নিষ্পত্তি করে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে আদেশ দেন আপিল বিভাগ। আদেশে বলা হয়, ঢাকার পারিবারিক আদালতে থাকা মামলাটি (২০২১ সালে শিশুদের বাবার করা) নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত জাপান থেকে আসা দুই শিশু তাদের মায়ের হেফাজতে থাকবে। শিশুদের বাবা তাদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পাবেন।

আদেশে আরও বলা হয়, মামলার পারিপার্শ্বিক বিষয় ও শিশুদের স্বার্থ বিবেচনায় তাদের এই আদালতের এখতিয়ারের বাইরে (দেশের বাইরে) নেওয়া যাবে না। আপিল বিভাগের আদেশের অনুলিপি পাওয়ার তিন মাসের মধ্যে সংশ্লিষ্ট পারিবারিক আদালতকে মামলাটি নিষ্পত্তি করতে নির্দেশ দেওয়া হয়।