সরকারি চাকরির সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিলের দাবিতে শিক্ষার্থীদের অবরোধে গতকাল বুধবার সারা দেশে কার্যত অচল হয়ে পড়ে সড়ক, মহাসড়ক ও রেলপথ। সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলা ‘বাংলা ব্লকেড’ নামের এই অবরোধে সারা দেশ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকা।
‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’–এর ব্যানারে এই অবরোধ কর্মসূচির কেন্দ্র ছিল রাজধানীর শাহবাগ। সেখান থেকে অবরোধ তুলে নেওয়ার আগে শিক্ষার্থীরা সরকারি চাকরির সব গ্রেডে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ কোটা রেখে কোটাব্যবস্থার যৌক্তিক সংস্কার করে আইন পাসের দাবি জানান। দাবি আদায়ে আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে সারা দেশে আবারও ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির ঘোষণা দেন তাঁরা।
গতকাল অবরোধ কর্মসূচির আওতায় ছিল সড়ক, মহাসড়ক ও রেলপথ। অবশ্য অ্যাম্বুলেন্স, রোগী বহনকারী যানবাহন ও গণমাধ্যমের গাড়ি অবরোধ কর্মসূচির আওতার বাইরে ছিল।
আন্দোলনকারীরা ঢাকাসহ গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোর বিভিন্ন মোড়ে অবস্থান নেন। এর মধ্যে ঢাকার যানবাহন চলাচলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অন্তত ১৮টি স্থানে অবরোধ করেন তাঁরা।
রাজধানীর বাইরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লায়, ঢাকা-আরিচার সাভারে, ঢাকা-খুলনার গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে, ঢাকা–কুয়াকাটার বরিশাল ও পটুয়াখালীতে, কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহের ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে, ঢাকা-রাজশাহীর চৌদ্দপাই এলাকায়, ঢাকা-দিনাজপুরের হাজী মুহম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে, ঢাকা-পাবনার মহাসড়কের পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে, ঢাকা–ময়মনসিংহের ত্রিশালে, ঢাকা–সিলেট–সুনামগঞ্জ মহাসড়কের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনেসহ গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন মহাসড়কের এক থেকে একাধিক স্থানে অবরোধ করা হয়। এসব অবরোধ কর্মসূচিতে অংশ নেন অন্তত ২৪টি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের শিক্ষার্থীরা।
অবরোধে অচল হয়ে পড়ে রেলপথও। রেলওয়ে সূত্র জানায়, ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, ময়মনসিংহসহ দেশের সাতটি স্থানে আন্দোলনকারীরা রেলপথ অবরোধ করেন। এ সময় ঢাকায় কোনো ট্রেন প্রবেশ করতে বা বের হতে পারেনি। এতে গতকাল দুপুর পৌনে ১২টা থেকে প্রায় ছয় ঘণ্টা ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ ছিল। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে রেল চলাচল শুরু হতে থাকে। দীর্ঘ সময় রেল চলাচল বন্ধ থাকায় পুরো দেশেই এর প্রভাব পড়ে। রেলের সূচিতে বিপর্যয় দেখা দেয়, ভোগান্তিতে পড়েন যাত্রীরা।
রাজধানীর মোড়ে মোড়ে আন্দোলনকারীরা অবস্থান নেওয়ায় অনেক যানবাহন ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকে। সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় দূরের গন্তব্যেও হেঁটে রওনা হন অনেকে। অনেকে আবার চলাচলের বিকল্প পথ হিসেবে মেট্রোরেল ব্যবহার করেন। যাত্রীর অতিরিক্ত চাপের কারণে কোনো কোনো মেট্রো স্টেশনের প্রবেশপথ কখনো কখনো বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনাও ঘটে।
আন্দোলনকারীরা বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত অধিকাংশ সড়ক অবরোধ করে রাখেন। তবে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সন্ধ্যা সাতটার দিকে জিরো পয়েন্ট মোড় ছাড়েন। আর অবরোধের প্রায় আট ঘণ্টা পর রাত পৌনে আটটার দিকে শাহবাগ মোড় থেকে অবরোধ কর্মসূচি তুলে নেওয়া হয়। এরপর যান চলাচল স্বাভাবিক হতে থাকে। তবে সারা দিন রাস্তা বন্ধের প্রভাবে যানজট থাকে গতকাল গভীর রাত পর্যন্ত।
এর আগে বেলা ১১টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল নিয়ে আন্দোলনকারীরা একে একে শাহবাগ, ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের মোড়, বাংলামোটর, পরীবাগ, কারওয়ান বাজার ও ফার্মগেট এলাকার সড়কে অবস্থান নেয়। এতে মগবাজার, মৌচাক, হাতিরঝিল, পান্থপথ মোড়, বিজয় সরণি, সংসদ ভবনসহ আশপাশের এলাকায় যান চলাচল স্থবির হয়ে পড়ে।
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আগারগাঁও সড়ক অবরোধ করেন। অবরোধের প্রভাব পড়ে মিরপুর এলাকার যান চলাচলেও। সায়েন্সল্যাব মোড় অবরোধ করায় নীলক্ষেত, নিউমার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড, মিরপুর রোড, ধানমন্ডি, রাইফেলস স্কয়ার, শংকর, আসাদগেট এলাকায় বন্ধ হয়ে যায় যান চলাচল।
মহাখালীর সড়ক অবরোধে উত্তরা, বনানী, গুলশানের দিকে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। রামপুরায় সড়ক অবরোধের প্রভাব পড়ে বাড্ডা, আবুল হোটেলসহ আশপাশের এলাকায়। অপর দিকে গুলিস্তানের জিরো পয়েন্ট, শিক্ষা ভবন মোড়, মৎস্য ভবন, পল্টন মোড়, কাকরাইল ও বকশীবাজারের সড়ক অবরোধ করা হয়। এতে শান্তিনগর, মতিঝিল, পুরান ঢাকা, আজিমপুরসহ ঢাকার দক্ষিণ অংশে যান চলাচলও বন্ধ হয়ে যায়।
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ফার্মগেটে নামার অংশে আন্দোলনকারীরা অবস্থান নেন। এতে এক্সপ্রেসওয়েতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকে বিভিন্ন যানবাহন। কয়েকজন বিদেশি কূটনীতিকের গাড়িও আটকা পড়ে। কারওয়ান বাজারে রেলপথেও অবরোধ করেন শিক্ষার্থীরা।
কোটা সংস্কারের দাবিতে সাভারের ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকসংলগ্ন মহাসড়কে এ কর্মসূচি চলে।
ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ করেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। দুপুর ১২টা থেকে বিকেল পৌনে ৪টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে মহাসড়ক অবরোধ করেন তাঁরা। এতে যোগ দেন রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। রাজশাহী কলেজের শিক্ষার্থীরা প্রতিষ্ঠানটির সামনের সড়ক অবরোধ করেন।
ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। গতকাল বেলা সাড়ে ১১টা থেকে বেলা সাড়ে ৩টা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা জেলার সদর দক্ষিণ উপজেলার কোটবাড়ীতে মহাসড়ক অবরোধ করেন। এতে মহাসড়কের দুই পাশে ময়নামতি ক্যান্টনমেন্ট থেকে পদুয়ার বাজার পর্যন্ত অন্তত ১০ কিলোমিটার এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়।
কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ মহাসড়ক অবরোধ করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। বেলা ১১টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকের সামনে শুরু করা এ কর্মসূচি চলে বিকেল ৪টা পর্যন্ত। বিকল্প কোনো পথ না থাকায় এ অংশ দিয়ে যাতায়াতকারী উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের যানবাহনগুলো আটকা পড়ে।
ঢাকা-বরিশাল ও বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সরকারি ব্রজমোহন (বিএম) কলেজের শিক্ষার্থীরা। এর মধ্যে বেলা ১১টা থেকে সাড়ে ৩টা পর্যন্ত বরিশালের কেন্দ্রীয় বাসস্ট্যান্ড এলাকা নথুল্লাবাদে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন বিএম কলেজ, শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও সরকারি সৈয়দ হাতেম আলী কলেজের শিক্ষার্থীরা। আর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বেলা ১১টা থেকে বরিশাল-কুয়াকাটা মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন বিকেল সাড়ে ৫টা পর্যন্ত। অবরোধ চলাকালে বরিশাল থেকে ঢাকা এবং বরিশাল থেকে পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি জেলার একাংশের পুরো সড়ক যোগাযোগ বন্ধ থাকে।
পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলার পায়রা সেতুর টোল প্লাজা এলাকায় ঢাকা-পটুয়াখালীর মহাসড়ক অবরোধ করে রাখেন পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ময়মনসিংহের ত্রিশালে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গতকাল বেলা তিনটায় ত্রিশাল বাসস্ট্যান্ড-সংলগ্ন এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করেন। পরে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা বিকেল পাঁচটার দিকে তাঁদের মহাসড়ক থেকে সরিয়ে দেন। এ সময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে বাগ্বিতণ্ডা ও ধাক্কাধাক্কি হয়।
এর বাইরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা কোটা সংস্কারের দাবিতে শহরের প্রধান প্রধান সড়কে বিক্ষোভ মিছিল করেন। শহরে বিক্ষোভ মিছিল করেন ফরিদপুর সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের শিক্ষার্থীরাও। তাঁরা ৪০ মিনিটের জন্য ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু সুপারমার্কেটের সামনে চার রাস্তার মোড়ে অবরোধ কর্মসূচিও পালন করেন।
বেলা সাড়ে ১১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত চট্টগ্রাম শহরে রেল ও সড়কপথ অবরোধ করেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীরা। চট্টগ্রাম রেলস্টেশনের ব্যবস্থাপক মো. মনিরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বেলা ১১টার পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অন্তত ১০টি ট্রেন চট্টগ্রাম স্টেশনে আটকা ছিল।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা গতকাল বেলা ১১টা থেকে বিকেল সোয়া ৫টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের আবদুল জব্বার মোড়সংলগ্ন ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথ অবরোধ করেন। এতে ঢাকা থেকে আসা দেওয়ানগঞ্জগামী তিস্তা এক্সপ্রেস ট্রেনটি সেখানে ছয় ঘণ্টার মতো আটকা ছিল।
গাজীপুরের মাটিখোলা এলাকায় সড়ক ও রেলপথ বন্ধ করে বিক্ষোভ করেন ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) শিক্ষার্থীরা। গতকাল দুপুরে এক ঘণ্টার মতো রেলপথ বন্ধ করে রাখেন তাঁরা।
কোটার যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে ১ জুলাই থেকে টানা আন্দোলনে আছেন শিক্ষার্থীরা। ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে গতকাল টানা চতুর্থ দিনের মতো ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন ও ছাত্র ধর্মঘট ছিল।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শিক্ষার্থীরা এখন এক দফা দাবিতে আন্দোলন করছেন। তাঁদের দাবিটি হলো সরকারি চাকরিতে সব গ্রেডে অযৌক্তিক ও বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে ন্যূনতম মাত্রায় এনে সংসদে আইন পাস করা। এ ক্ষেত্রে সব গ্রেডে সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ কোটা রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন তাঁরা।
এ দাবির বিষয়ে গতকাল রাজধানীর শাহবাগের সমাবেশে আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, ‘আমাদের দাবি আদালতের কাছে নয়, সরাসরি নির্বাহী বিভাগের কাছে। আদালত কাজ করছেন ২০১৮ সালের পরিপত্র নিয়ে। পরিপত্রের ক্ষেত্রে যেকোনো সিদ্ধান্ত আসতে পারে; কিন্তু আমাদের এক দফা দাবি শুধু রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ বা সরকারই পূরণ করতে পারে।’
নতুন কর্মসূচির ঘোষণা দেন আন্দোলনের আরেক সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ। তিনি বলেন, ‘আগামীকাল (আজ) বিকেল সাড়ে তিনটা থেকে সারা দেশে রেলপথ ও সড়কে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি। সারা দেশে শিক্ষার্থীরা তাঁদের নিকটস্থ পয়েন্টে ব্লকেড কর্মসূচি পালন করবেন।’
[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন প্রথম আলোর সংশ্লিষ্ট স্থানের প্রতিনিধিরা]