বাংলাদেশ–মিয়ানমার সীমান্ত

সীমান্তে যখন গুলির শব্দ শুনছে ঘুমধুম

বৈশ্বিক ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ আরাকানের গুরুত্ব বাড়িয়েছে। এটা চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক জায়গা।

মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ছোড়া মর্টারের গোলা। গত ২৮ আগস্ট
ছবি: বান্দরবান জেলা পুলিশের সৌজন্যে

বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্ত বেশি বড় নয়। ৩০০ কিলোমিটারেরও কম। কিন্তু ক্রমে স্থায়ী এক উদ্বেগের ঠিকানা হয়ে উঠছে এ জায়গা। ২০১৭ সালের নির্মম স্মৃতির পর মিয়ানমারের দিক থেকে আবারও এই সীমান্তে উসকানিমূলক কাজকারবার শুরু হয়েছে।

‘টাটমাড’ নামে স্থানীয়ভাবে পরিচিত মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী ৭৫ বছর ধরে দেশটির কোথাও না কোথাও নিজ জনগণের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত আছে। কিন্তু এখন তারা বাংলাদেশের দিকেও মর্টার ও গুলি ছুড়ছে। বাড়তি সৈন্য এবং ভারী অস্ত্রপাতি মজুতের বিশ্বাসযোগ্য খবরও আসছে ওদিক থেকে।

সীমিত পরিসরের ঘটনাবলি হলেও বাংলাদেশ সরকার এতে অসন্তোষ জানাতে বিলম্ব করেনি। কিন্তু একই সঙ্গে এ পরিস্থিতির পরোক্ষ পার্শ্বফল হিসেবে রোহিঙ্গাদের ফেরতের বিষয় বিলম্বিত হওয়ার আলামতও স্পষ্ট।

নাইক্ষ্যংছড়ি সীমান্তের ওপারে মিয়ানমারের আকাশে উড়ছে হেলিকপ্টার। গত ৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে

আরাকানে আকাশ-আক্রমণ বাড়িয়েছে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী

২০১৭ সালে দক্ষিণ সীমান্ত বাংলাদেশের মনোযোগ কেড়ে নিয়েছিল আরাকান থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের কারণে। ঠিক পাঁচ বছর পর আবারও বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের আরাকানমুখী হতে হচ্ছে সেখানে আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর যুদ্ধের কারণে।

সেই যুদ্ধের সর্বশেষ আঁচ বান্দরবানের থানচি ও নাইক্ষ্যংছড়িতে বেশ উত্তাপ ছড়াচ্ছে এখন। নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমের তুমব্রু এলাকার অনেকেই সীমান্তের এদিকে গুলি এসে পড়ার অভিজ্ঞতা শোনান সাংবাদিক পেলে। ৩৭ থেকে ৪০ নম্বর সীমান্ত পিলার সন্নিহিত অপর দিকে প্রতিদিন পাল্টাপাল্টি হামলা চলছে। এখানকার আকাশে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর হেলিকপ্টারের আনাগোনার কথাও গণমাধ্যমে এসেছে। উত্তর আরাকান ও চিন প্রদেশের বান্দরবান–সংলগ্ন এলাকায় এ অবস্থা চলছে। প্রথমে সবার ধারণা ছিল এ রকম খণ্ডযুদ্ধ হয়তো দীর্ঘায়িত হবে না।

এখন মাঠপর্যায়ে অনুমান ভিন্ন। আরাকানে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে আরাকান আর্মির ২০২০ সালের নভেম্বরের যুদ্ধবিরতি-সমঝোতা ভেঙে গেছে বলা যায়। আর উভয়ে চাইছে বাংলাদেশ–সংলগ্ন সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ। ৩১ আগস্ট ও ১২ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া দুটি গুরুত্বপূর্ণ চৌকি মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে আরাকান আর্মি তাদের গেরিলা সংগ্রামের নবপর্যায়ের কথা জানিয়ে দিল আশপাশের সবাইকে। তবে তাদেরও ক্ষয়ক্ষতি ঘটছে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর বিমান হামলায়।

কেন গুলির শব্দ উদ্বেগ ছড়াল

আন্তসীমান্ত বাণিজ্যের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকলেও মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মাঝে পণ্য ও সেবার আনুষ্ঠানিক লেনদেন কম। তবে সীমান্ত এলাকার মানুষের ভাষ্য হলো, এখানে অনানুষ্ঠানিক ব্যবসারও বড় এক অর্থনীতি আছে। এ ছাড়া আরাকানে সামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার চলতি লড়াইয়ে মিয়ানমারের বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন এলাকা বিবদমান দুই পক্ষের জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

অভিযোগ আছে, আরাকান আর্মির জনবল সীমান্তসংলগ্ন তাদের এলাকা গোপনে কৌশলগত কাজে ব্যবহার করে। বাংলাদেশের তরফ থেকে নিজস্ব সীমান্তে এ ব্যাপারে কড়া নজরদারি ও বাধা আছে।

আরাকান বা রাখাইনজুড়ে তাদের যে সামরিক লক্ষ্য এবং পরিকল্পনা, তাতে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর নতুন করে হামলার মুখে আরাকান আর্মি বাংলাদেশ–সংলগ্ন সীমান্ত কোনোভাবেই হাতছাড়া করতে চাইছে না। বরং এখানে সামরিক প্রভাব আরও বাড়াতে চায়।

সীমান্তবর্তী মানুষের সঙ্গে গণসংযোগে তাদের নানামুখী বিনিয়োগ আছে। এই গেরিলা দল এ রকম কথা একদম লুকাচ্ছে না যে তারাই আরাকানের ‘কর্তৃপক্ষ’ হয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে এ সীমান্তে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে চায়। এ বছরের ২ জানুয়ারি প্রথম আলোয় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে আরাকান আর্মি প্রধান স্বঘোষিত জেনারেল ওয়াং ম্রা নাইং সে রকমই বলেছিলেন।

কোনোভাবে আর আরাকান আর্মিকে সহ্য করতে চায় না মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী। যেকোনো মূল্যে তারা দুই দেশের সীমান্তসংলগ্ন এলাকা থেকে এই দলের গেরিলাদের তাড়াতে চায়। তারই ফল সাম্প্রতিক উত্তেজনা, সংঘর্ষ, গোলাগুলি। ১৩ আগস্ট থেকে এই পাল্টাপাল্টি চলছে। মাঝে মাঝে সেই সংঘাতের মর্টার ও গুলি এসে পড়ছে বান্দরবানে।

মর্টার ও গুলির এই ছিটকে আসার ঘটনা মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর তরফ থেকে অসচেতন বা অনিচ্ছাসত্ত্বে হচ্ছে—কেউই এমন মনে করে না। মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর এসব গোলাগুলিতে হয়তো বাংলাদেশকে কোনো নীরব বার্তা দিয়ে থাকবে। সেই বার্তায় মিশে থাকতে পারে এই অঞ্চলে আরাকান আর্মির বাড়বাড়ন্ত নিয়ে তার অসন্তোষ। তবে বাংলাদেশ সরকার যে গভীর তীব্র ক্ষোভের সঙ্গে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর গোলাগুলির ঘটনা দেখছে, সেটা দেশটির রাষ্ট্রদূতকে পুনঃপুন তলবে পরিষ্কার বোঝা যায়।

কিন্তু মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীকে থামাতে এটুকুই যথেষ্ট কি না, সে প্রশ্ন আছে। পাহাড়ি যুদ্ধে অতি দক্ষ এ বাহিনীর হাত থেকে সীমান্ত সুরক্ষায় বাংলাদেশ আর কী করতে পারে, সেটাও এক জটিল গণিত হিসেবে সামনে এসেছে। বিশেষ করে যখন রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠাতে হলে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গেও বোঝাপড়ায় আসতে হবে।

যুদ্ধের ভরকেন্দ্র পালেতোয়া

মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী এবং আরাকান আর্মির মধ্যে যেসব জায়গায় এখন সংঘর্ষ চলছে, তার মধ্যে আছে মংডু, বুথিডং, রাথিডং, ম্রাউক-উ (প্রাচীন আরাকানের রাজধানী) এবং পালেতোয়া। যুদ্ধের প্রধান ভরকেন্দ্র পালেতোয়া। এই জায়গাটা যদিও চিন প্রদেশে পড়েছে কিন্তু আরাকান আর্মি মনে করে, এটা উত্তর আরাকানেরই অংশ।

বামাররা একসময় পালেতোয়াকে আরাকান থেকে কেটে চিনের সঙ্গে জুড়ে দিয়েছে। খুকি চিনদের এলাকা হলেও রাখাইনদের ভাষাগত আধিপত্য প্রবল এখানে। যদিও এলাকায় রাখাইনরা সংখ্যালঘু। বামারদের ভাষায় এখানে কেউ কথা বলে না।

কালাদান নদী এই জনপদে যোগাযোগের বড় মাধ্যম। বলা যায়, পালেতোয়াকে মধ্যে রেখে মিজোরাম থেকে রাখাইনের দিকে বয়ে যাওয়া কালাদানই এই জনপদের মূল ‘মহাসড়ক’। একদা এই মহাসড়কের মুরুব্বি ছিল চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের গেরিলারা। এখন তারা ‘শান্তাবস্থা’য় আছে। সেই জায়গা দখল করছে পাশের প্রদেশের রাখাইনের যুবারা।

দুর্গম এই অঞ্চল ত্রিদেশীয় একটা সীমান্তবিন্দুও বটে। বাংলাদেশ, মিয়ানমার এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের সীমান্ত রয়েছে এখানে।

বিশ্বের বহু জায়গায় ত্রিদেশীয় সীমান্ত এলাকাগুলো নিয়ে নানান উত্তেজনা থাকে। মিয়ানমার, লাওস ও থাইল্যান্ডের ত্রিদেশীয় সীমান্তবিন্দু ‘গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গল’ সে রকম একটি এলাকা, যার বিস্তর কাহিনি বাংলাদেশের ‘মাসুদ রানা’ পাঠকদের জানা। পালেতোয়ার সে রকম গল্প সামান্যই লেখা হয়েছে। লেখা সহজও নয়। নিরাপত্তার কারণে সেখানে যাওয়া কঠিন বিদেশিদের পক্ষে। অনুমতি পাওয়া যায় না।

বছরের আগস্ট-সেপ্টেম্বরে কালাদান নদীর দুই পাড়ে তুমুল বর্ষা থাকে। ফলে মানুষের চলাচল বিঘ্নিত হয়। এবার সেই বিঘ্ন আরও বাড়াল তুমুল গুলি বিনিময়।

মিয়ানমারের সবচেয়ে গরিব প্রদেশ চিন। তার মধ্যে সবচেয়ে গরিব এলাকা পালেতোয়া। ফলে গাঢ় বর্ষায় তুমুল যুদ্ধে সেখানকার বাসিন্দাদের এখন নাভিশ্বাস অবস্থা। প্রান্তিক মিয়ানমারের এই পাহাড়ি অতি গরিবদের বাড়তি দুর্ভাগ্য বয়ে এনেছে এখানে ভারতের বিশাল বিনিয়োগ।

যার কাগুজে নাম ‘কালাদান বহুমাত্রিক যোগাযোগ প্রকল্প’। ভারতের প্রথম সারির দৈনিক দ্য হিন্দুর তথ্য অনুযায়ী, মিজোরামকে সামনে রেখে পালেতোয়ার ওপর দিয়ে পুরো উত্তর–পূর্ব ভারতকে বঙ্গোপসাগরে যুক্ত করতে ৪৮৪ মিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্প। কিন্তু ১৪ বছর হলো কাজটি শেষ করা যাচ্ছে না।

এই বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ বাঁচাতে ভারত মিয়ানমারের জান্তার মধ্যপন্থী এক সমর্থকের ভূমিকাও ছাড়তে পারছে না। আরাকান আর্মি ও মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর চলতি মারামারির পেছনে কালাদানকে ঘিরে আন্তর্দেশীয় ওই বিনিয়োগেরও ভূমিকা আছে বলে মনে করা হয়।

ভারতের বাইরে নয়াদিল্লির অন্যতম বড় বিনিয়োগ ‘কালাদান’। আরাকান ও পালেতোয়ায় কে এই প্রকল্পের অবকাঠামোর নিরাপত্তাগত অভিভাবকত্ব করবে, তারই সামরিক ফয়সালার শিকার হচ্ছে আশপাশের খুমি-চিন এবং রাখাইন গরিব মানুষ। যদিও তার প্রচ্ছদ হিসেবে আছে বামার আর রাখাইনদের ঐতিহাসিক জাতীয়তাবাদী টানাপোড়েনও।

সেই টানাপোড়েনে উভয়ে যেন আপন আপন স্বার্থে কাছে টানতে চায় সীমান্তের অপর দিকের বাংলাদেশকেও। হয়তো কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে গণচীনও আরাকানের এই পাশা খেলায় নজর রাখছে উৎসাহের সঙ্গে।

আরাকান ও চিনের ভেতরকার অবস্থা

পালেতোয়ার এই যুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশের পত্রপত্রিকায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়ালেও উদ্বাস্তুর সারি বান্দরবানমুখী নয় এবার। নতুন করে ঘরবাড়িহারা মানুষেরা কেউ যাচ্ছে মিজোরামে—অন্যরা দেশের ভেতরই বিভিন্ন দিকে আশ্রয় নিচ্ছে। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তাবিষয়ক সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, গত এক মাসের যুদ্ধে ৯ হাজার ৬০০ মানুষ উদ্বাস্তু হয়েছে। দক্ষিণ চিন ও আরাকান মিলে এখন মোট যুদ্ধ-উদ্বাস্তুর সংখ্যা ৮৪ হাজার।

২০২১ সালে নেপিডোতে অভ্যুত্থানের পর চিন ও আরাকান থেকে মিজোরামে নতুন করে উদ্বাস্তু ঢুকেছে ৩০ হাজার। এই উদ্বাস্তুরা যে মিজোরামমুখী, তার দুটি কারণ আছে। পালেতোয়ার খুমি-চিনরা মিজোদের মতো ধর্মে খ্রিষ্টান।

আবার শরণার্থীদের মিজোরা জাতিগত নিকটজন হিসেবেও দেখে। ঠিক একই ধাঁচের বন্ধনের ওপর ভরসা করে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর বন্দুকের হাত থেকে বাঁচতে রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের দিকে চলে এসেছিল পাঁচ বছর আগে।

আপাতত বাংলাদেশের দিকে গুলির পাশাপাশি উদ্বাস্তু না এলেও সেটা ভবিষ্যতে আসতে পারে। মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী নির্মমভাবে ম্রাউক-উতে রাস্তাঘাট অবরোধ করে প্রায় দুর্ভিক্ষাবস্থা তৈরি করেছে। রাথিডং-বুথিডংয়ের দিকেও একই রকম কৌশল নিয়েছে তারা। আকিয়াবে প্রবেশের সব মুখে চেক পয়েন্ট বসেছে। যেখানে আগে থেকে চেক পয়েন্ট ছিল না, সেখানে নতুন করে সেটা বসছে। এতে স্থানীয় গরিব খেটে খাওয়া মানুষের খুব সমস্যা। চলাচলে নিয়ন্ত্রণ বাড়ায় স্কুলগুলোও একে একে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

রোহিঙ্গা ও রাখাইনদের মধ্যে বিভেদ তৈরিরও প্রবল উসকানি আছে মাঠে। মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী পুরো সংঘাতকে ত্রিমুখী-চতুর্মুখী রূপ দেওয়ার কৌশল নিয়ে কাজ করছে বলে মাঠে সাক্ষ্য মেলে। আরাকান আর্মির নিত্যদিনের অ্যামবুশও সমাজকে আতঙ্কময় করছে।

টাটমা-ডর আকাশ হামলা রুখতে না পারলেও জমিনে রাখাইনরা প্রতিদিন নানান চোরাগোপ্তা হামলা চালাচ্ছে। এতে এসব এলাকায় সরকারি প্রশাসন বলতে তেমন কিছু নেই বলা যায়। দারিদ্র্য অবস্থা তাতে আরও করুণ চেহারা নিচ্ছে কেবল। উত্তর আরাকানের অবশিষ্ট রোহিঙ্গারা এ অবস্থায় বাড়তি অর্থনৈতিক দুর্দশায় আছে।

বাংলাদেশের ধৈর্যে হাতুড়িপেটা

অনেকেই ইদানীং বলছেন, বৈশ্বিক ‘ঠান্ডা যুদ্ধ’ আরাকানের গুরুত্ব বাড়িয়েছে। এটা চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত সবার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক জায়গা। যদিও বাংলাদেশ ঘরের কাছের এ রকম জায়গার গুরুত্বের ফসল নিজের ঘরের দিকে টানতে পারছে না তারা। ১১ লাখ রোহিঙ্গাকে ফেরতের চাপ ভূরাজনীতিতে বাংলাদেশের হাত-পা বেঁধে রেখেছে এবং ঢাকার পক্ষপাত এখনো নেপিডোর সামরিক জান্তার দিকেই হেলে আছে।

তবে এ সপ্তাহে আরাকানের সমর পরিস্থিতির নাটকীয় মোড়ের মতো পুরো মিয়ানমারও দেশটির সশস্ত্র বাহিনীর জন্য ছিল বিপর্যয়কর। আরাকানে অন্তত দুটো সামরিক চৌকি হারানো ছাড়াও কারেন ও শান অঞ্চলে তারা বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে। এসব যখন ঘটছিল সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাই তখন তৃতীয় দফা মস্কো সফরে ছিলেন। কেবল মস্কো ছাড়া তাঁর পাশে প্রকাশ্যে শক্তভাবে কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না এখন।

আর ১০ দিন পর জেনারেল মিন অং হ্লাইয়ের সামরিক শাসনের ৬০০ দিন পূর্ণ হবে। সামরিক শাসন জারিকালে এখানকার জেনারেলদের অনুমান ছিল মাত্র দুই মাসে সব নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। কিন্তু বাস্তবে ঘটেছে উল্টো। ইতিমধ্যে প্রায় ‘ব্যর্থ রাষ্ট্রে’ পরিণত হয়েছে দেশটি।

আগামী অক্টোবরে আন্তর্জাতিক ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্কফোর্স (এফএটিএফ) মিয়ানমারকে কালো তালিকাভুক্ত করতে পারে বলে খবর বেরিয়েছে। এটা হলে দেশটি আন্তর্জাতিক লেনদেনে বড় ধরনের ভাবমূর্তি সংকটে পড়বে। তাদের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুরূপ আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এড়িয়ে চলতে পারে। বর্তমানে এ রকম তালিকায় আছে ইরান ও উত্তর কোরিয়া।

তবে এত সব বিপদ ও ঝুঁকির মধ্যে আরাকানের যুদ্ধাবস্থায় ক্রমাগত বাড়তি শঙ্কা ছড়াচ্ছে শাসক পরিমণ্ডলে। মধ্য মিয়ানমারে অং সান সু চির জাতীয় ঐক্য সরকারের (এনইউজি) গেরিলারা যে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করছিল, তার কোনো ঢেউ এত দিন আরাকানে লাগেনি। প্রায় পূর্ণ স্বস্তির একটা জায়গায় এখন মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী আক্রান্ত হচ্ছে। আবার একই সঙ্গে এখানে আছে চীন-ভারতের বিপুল বিনিয়োগ।

আরাকানের এই সশস্ত্রতা এনইউজিকে সুবিধা দিচ্ছে বিদেশে মিয়ানমারের পরিস্থিতি বিষয়ে নিজেদের বক্তব্যকে ন্যায্যতা দিতে। কিন্তু আরাকানের এই সশস্ত্রতার করুণ ছাপ পড়েছে বান্দরবান ও কক্সবাজারের রোহিঙ্গাদের মধ্যে। দূর থেকে আরাকানের আকাশে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখে তারা ভুগছে নতুন হতাশায়। এত সশস্ত্রতার স্বদেশে তারা কীভাবে ফিরতে পারে?

অন্যদিকে বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের জন্য পরিস্থিতি কেবল হতাশারই নয়, দুশ্চিন্তারও। আলোচনার টেবিলে না এসে মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনী আকাশে হেলিকপ্টার ঘুরিয়ে যা বলতে চায়, সেটা ইঙ্গিত হিসেবে খারাপ ও উসকানিমূলক। আরও সরাসরি বললে, বাংলাদেশের ধৈর্যে হাতুড়ি পেটানোর মতো।

আলতাফ পারভেজ, ইতিহাস বিষয়ে গবেষক