২৮ মণ ধানের দামে বিক্রি মা–ছেলে

সিলেট সাবরেজিস্ট্রি অফিসের মহাফেজখানা থেকে পাওয়া তিনটি অপ্রকাশিত দলিলে রয়েছে মানুষ বিক্রির তথ্য।

শেখ বিআনিয়া বিক্রি হয়েছিলেন ৪০ কাহন কৌড়িতে। সোয়া দুইশো বছর আগে মানুষ বিক্রির দলিল

গনাই ভান্ডারি তাঁর দামটা একটু বেশি পেয়েছিলেন। সনাই বা ভূবিদাসীর দাম যখন ১০ বা ১৫ টাকা, তখন গনাই বিক্রি হয়েছিলেন ২৫ টাকায়। মূল্য যা–ই হোক, প্রায় সোয়া দুই শ বছর আগে দাস হিসেবে বিক্রির সময় তাঁদের সবাইকেই লিখে দিতে হয়েছে নিজেকে। ক্রেতারা ছিলেন একই জেলার বিভিন্ন স্থানের বাসিন্দা। বাংলায় দাস হিসেবে সবচেয়ে কম মূল্য ছিল শিশুদের। ৫০ বছরের জন্য মাত্র সোয়া ১ রুপিতে বিক্রি হয়েছিল ৪ বছরের শিশু জমিয়ত।

আঠারো শতকের প্রথম দিকে মানুষ বিক্রির চারটি দলিল আছে সিলেট সদর সাবরেজিস্ট্রি অফিসের মহাফেজখানায়। সে সময়ের বালাম বই থেকে তিনটি দলিল এ বছরের নভেম্বরে সংগ্রহ করেন এই প্রতিবেদক। তাতে উঠে এসেছে চারজন মানুষ বেচাকেনার প্রমাণ। পাওয়া গেছে ঋণ শোধের জন্য মা–সহ এক সন্তানের নিজেকে বিক্রির ইতিহাস।

১৭ বছরের গনাই ভান্ডারিকে দাস হিসেবে কিনেছিলেন দুইজন। গনাইয়ের দাম ছিল ২৫ টাকা

তিন দলিলে লেখা মানুষের দাম

২৫ বছরের যুবক শেখ বিআনিয়া বলেছিলেন, আজীবন সে দাস থাকবে। কাজে গাফিলতি করবে না। আর পালিয়ে গেলে ধরে এনে মনিব যে শাস্তি দেবে, সে মাথা পেতে নেবে। বিআনিয়ার মৌখিক স্বীকারোক্তির পরিপ্রেক্ষিতে লেখা হয়েছিল মানুষ বিক্রির একটি দলিল। ফয়েজউল্লাহ নামে স্থানীয় এক ব্যক্তি মাত্র ৪০ কাহন কৌড়ি অর্থাৎ সে সময়ের ১০ রুপিতে দাস হিসেবে কিনে নিয়েছিলেন শেখ হাবিবের ছেলে শেখ বিআনিয়াকে। বিআনিয়া জানিয়েছিল, কর্জ শোধের জন্য বিক্রি করছেন নিজেকে। ১৮০৬ খ্রিষ্টাব্দ, বাংলা ১২১৩ সালের ১ পৌষ নথিভুক্ত হয় এ দলিল।

১৮০৭ সালে পরপর দুই দিন লেখা হয়েছিল মানুষ বিক্রির আরও দুটি দলিল। কেন্দরাম ও গঙ্গারাম নামে দুই ভাই কিনেছিলেন ১৭ বছরের গনাই ভান্ডারিকে। অনুপ রায় বেপারি নামে এক ব্যক্তির কাছ থেকে ২৫ টাকায় কেনা হয়েছিল গনাইকে।

এই দলিলটি দাস হিসেবে পরবর্তী প্রজন্মের আগেই বিক্রি হওয়ার এক ইতিহাস বটে। গনাইয়ের সন্তান হলে তাঁরাও একই মালিকের ক্রীতদাস হবে বলে শর্ত দেওয়া আছে নথিতে। ১৮০৭ খ্রিষ্টাব্দে, বাংলা ১২১৩ সালের ৫ ফাল্গুন এই বেচাকেনা নথিবদ্ধ হওয়ার মাত্র এক দিন আগে বিক্রি হয়েছিল মা আর ছেলে। তাদের মূল্য ছিল গনাইয়ের প্রায় অর্ধেক। সনাই দাষ তীর্ত্ত স্বীকারোক্তি দিয়েছেন, মা ভূবিদাসীসহ নিজেকে বিক্রি করছেন বাধ্য হয়ে। শ্রীহট্টের (সিলেট) বীনারপুরের মামুদপুরের বিনোদরাম দাস ও খনারাম দাস নামে দুই ভাই কিনেছিল ভূবিদাসী আর তাঁর ছেলে সনাইকে। দুজন মানুষের দাম নির্ধারণ হয়েছিল মাত্র ২৮ টাকা।

আজিজুর রহমান পড়ছেন সোয়া দুইশ বছর আগের দলিল

এই তিনটি দলিলে দেখা যায়, আঠারো শতকের শুরুতে কেউ প্রথমবার বিক্রি হয়েছেন দাস হিসেবে। কারও ক্ষেত্রে ঘটেছে শুধু মনিব বদলের ঘটনা। ১৮০৬-১৮০৮ সালের ২৩২ পৃষ্ঠার বালাম বইয়ের ৩৪, ৮০ ও ৮১ নম্বর পৃষ্ঠার দলিল তিনটি সিলেটের অভ্যন্তরে মানুষ কেনাবেচার।

এই দলিল তিনটি উদ্ধারের সূত্র ছিল ১৮০১ সালে মানুষ কেনাবেচার আরেকটি দলিলের কপি। সেই চতুর্থ দলিলটিও পাওয়া গেছে আরেক বালাম বইতে। ৩৫ বছরের নব দাসী আর তাঁর ৯ বছরের কন্যা অমরা দাসীর বিক্রি হওয়ার নথি সেটি। এটি সিলেট সদর সাবরেজিস্ট্রি অফিসের বালাম বইয়ে থাকা মানুষ বেচাকেনার সবচেয়ে পুরোনো দলিল।

চারটি দলিলই লেখা হয়েছে কয়েকটি ভাষা মিলিয়ে। এগুলো উদ্ধারের পর তা নিয়ে যাওয়া হয় আইনজীবী ও শ্রীহট্ট সংস্কৃত কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দিলীপ কুমার দাশ চৌধুরীর কাছে। প্রাথমিকভাবে সব কটিরই পাঠোদ্ধার করে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব দলিলে অসমিয়া, সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে ব্যবহৃত হয়েছে নাগরী লিপিও। মানুষ বেচাকেনার এই দলিলগুলো লেখার সময় তিনজন করে সাক্ষী রাখা হয়েছে। নিয়ম ছিল বেচাকেনা হওয়ার এক মাসের মধ্যে তা নথিবদ্ধ করতে হবে।’

সিলেট সদর সাব রেজিষ্ট্রি অফিসের দলিল সংরক্ষণের একটি কক্ষ

যেভাবে পাওয়া গেল দলিল

মানুষ বিক্রির দলিলগুলোকে সাধারণত বলা হতো কবলাপত্র। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ ১৮০১ সালের মানুষ বেচাকেনার দলিলের (নব দাসী ও অমরা দাসী বিক্রির নথি) একটি নকল কপি সিলেট সাবরেজিস্ট্রি অফিস থেকে সংগ্রহ করে। তারই একটি ফটোকপি ২৯ সেপ্টেম্বর এই প্রতিবেদক সংগ্রহ করেন আর্কাইভস কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। সেই দলিলের সূত্র ধরে আইন মন্ত্রণালয়ের নিবন্ধন অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়ে সিলেট সাবরেজিস্ট্রি অফিসের বালাম বই দেখা হয়।

প্রায় দেড় হাজার পৃষ্ঠার এই বালাম বইগুলোর অধিকাংশ দলিল নাগরী লিপি, উর্দু, ফারসি, ব্রজবুলি ও সংস্কৃত ভাষায় লেখা। যার বেশির ভাগই তৎকালীন জমি কেনাবেচার তথ্য। এর মধ্য থেকে মানুষ বিক্রির দলিল বের করতে সহযোগিতা নেওয়া হয় সিলেটের জৈন্তাপুরের হরিপুরের বাসিন্দা ৮৪ বছর বয়সী দলিল লেখক আজিজুর রহমানের। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় নাগরী হরফ ও সংস্কৃত ভাষার সঙ্গে কিছুটা পরিচিত তিনি।

৩১ অক্টোবর ও ১ নভেম্বর মহাফেজখানার পাঁচটি বালাম বই পড়ে উদ্ধার করা হয় ১৮০৬ সালের একটি ও ১৮০৭ সালের দুটি দলিল। অধ্যাপক দিলীপ কুমার দাশ চৌধুরীর অনুবাদের পর তা পুনরায় যাচাই করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের সহযোগিতায়। এই চারটি দলিলেই আছে অভাবের কারণে মানুষ বিক্রির ইতিহাস। এ প্রসঙ্গে উঠে আসে সে সময় বাংলার অন্যান্য অঞ্চলে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে মানুষ বিক্রির তথ্যও।

সিলেট সদর সাব রেজিষ্ট্রি অফিসের পুরানো ভবনটি শতবর্ষী। ১ নভেম্বরের ছবি

মানুষ কেনার বিজ্ঞাপন ও তৎকালীন অন্যান্য চিঠি

বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে এবং সিলেটের ভাষাসৈনিক মতিন উদ্দীন আহমদ জাদুঘরে রাখা আছে মানুষ বিক্রির দুটি দলিল। জাতীয় জাদুঘরের দলিলটি ইংরেজি ১৮০৮ সালের। ময়মনসিংহে ১৩ টাকায় ৬ বছরের কন্যাশিশুর বিক্রির ইতিহাস। মতিন উদ্দীন জাদুঘরের নথিটি ১৮৩৬ সালে সিলেটের জকিগঞ্জে ১২ বছরের কন্যাশিশুর ১১ টাকায় বিক্রি হওয়ার তথ্য।

এ ছাড়া এ অঞ্চলের চট্টগ্রাম ও তৎকালীন বিক্রমপুর, বর্তমান মুন্সিগঞ্জে লিখিতভাবে মানুষ বেচাকেনা হতো বলে জানা যায়। অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি রচিত শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত: উত্তরাংশ এবং শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত: পূর্বাংশ দুই খণ্ডের মধ্যে আছে মানুষ বিক্রির আরও দুটি দলিল। বিভিন্ন স্থানে যেমন মানুষ বিক্রির দলিলের সন্ধান পাওয়া যায়, তেমনি মানুষ কেনার জন্য বিজ্ঞাপন দেওয়ার নমুনাও রয়েছে পুরোনো সংবাদপত্রে। এমন একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল বেঙ্গল গেজেট পত্রিকায়। সেখানে কলকাতাবাসী জনৈক ভদ্রলোকের জন্য সুদেহী দুই নারী চাওয়ার বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল ১৭৮০ থেকে ১৭৮২ সালের মার্চের মধ্যে কোনো একদিন।

১৮২৫ সালের ১৮ জুন বাঙ্গালা সমাচারপত্র সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় কন্যা বিক্রির একটি খবর। ৩ বছর পর ১৮২৮ সালের ১১ অক্টোবর প্রকাশ হয় ভার্যা (স্ত্রী) বিক্রির খবর। তুলার মূল্যবৃদ্ধিতে আতঙ্কিত হয়ে নিজের স্ত্রীকে এক যুবকের কাছে কিছু টাকায় বিক্রি করেছিলেন বর্ধমানের এক ব্যক্তি। ব্রজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত সংবাদপত্রে সেকালের কথা বইতে পাওয়া যায় এসব তথ্য।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাফেজখানায় থাকা নথিতে বাংলায় ১৬৪৯ সাল থেকে ১৭৫৪ সালের মধ্যে বিক্রি হওয়া ১৯ জনের একটি তালিকা আছে। এর মধ্যে ১২ জন মানুষের বিক্রির কারণ উল্লেখ করা হয়েছে অনাহার। সম্প্রতি প্রয়াত অর্থনীতিবিদ আকবর আলি খান তাঁর দারিদ্রের অর্থনীতি: অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বইয়ে বাংলার দাসপ্রথা প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘বাংলায় ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় অনেক কম দামে দাস বিক্রি হতো।’ আকবর আলি খান জানিয়েছেন, নিঃস্ব স্বাধীন, নির্ভরশীল শিশু, আগে বিক্রি হওয়া দাস এবং দাসদের সন্তান—এই চার ধরনের মানুষ তখন বেচাকেনা হতো।

এ অঞ্চলের মানুষ বেচাকেনার ১৭৯০ সালের একটি দলিল পাওয়া যায় চৌধুরী হারুন আকবরের লেখা আভিজাত্যে সিলেটী সমাজ বইয়ে।

২৩২ বছর আগের ওই দলিলে আছে, জমিয়ত নামে চার বছরের এক শিশুর বিক্রির ইতিহাস। অভাবের কারণে নিজের সন্তানকে মাত্র ৫ কাহন কৌড়িতে বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিলেন হবিগঞ্জের নবীগঞ্জের দিনারপুরে পরগনার এক অসহায় বাবা।

স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার পাশাপাশি বাংলায় তখন প্রচলন ছিল কড়ির। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষ থেকে সিলেটে নিযুক্ত শাসনকর্তা রবার্ট লিন্ডসে তাঁর আত্মজীবনী অ্যানেকডটস অব অ্যান ইন্ডিয়ান লাইফ বইয়ের একটি পর্বে দেখিয়েছেন, বাংলায় তখন ৫ হাজার ১২০ কড়ি ছিল ১ রুপির সমান। অর্থাৎ ১৭৯০ সালে জমিয়ত নামের শিশুটি বিক্রি হয়েছিল সোয়া ১ রুপিরও কম মূল্যে।

তখনকার শস্য ও ফসলের মূল্যের ধারণা পাওয়া যায় কোম্পানি আমলে ঢাকায় নিযুক্ত কর্মকর্তা জেমস টেলরের দেওয়া হিসাব থেকে। কোম্পানি আমলে ঢাকা বইতে টেলর উল্লেখ করেছেন, ১৮১০ থেকে ১৮৩৬ সালের মধ্যে ১ টাকায় পাওয়া যেত ১ মণ আমন ধান। এই সব দলিলগুলোর সময়কাল ১৮০১ থেকে ১৮০৭ সাল, যখন ভূবিদাসী ও তাঁর ছেলে দুজন মিলে নিজেকে বিক্রি করেছিলেন মাত্র ২৮ মণ ধানের মূল্যে।