মনীষী সরদার ফজলুল করিম সারা জীবন মানবতাকে বিকশিত করার কাজ করে গেছেন। তাঁর কাজের পরম্পরা সমাজে থেকে যাবে। তরুণ সমাজকে এই কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। একটি শোষণমুক্ত, শ্রেণিবৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই প্রকৃতপক্ষে মানবমুক্তি সম্ভব।
সরদার ফজলুল করিমের নবম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত এক স্মরণসভায় বক্তারা তাঁর অবদানের কথা তুলে ধরতে গিয়ে এসব কথা বলেন। আজ বৃহস্পতিবার বিকেলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র মিলনায়তনে এই স্মরণসভার আয়োজন করে সরদার ফজলুল করিম স্মৃতি পরিষদ। ২০১৪ সালের ১৫ জুন তিনি ইন্তেকাল করেন।
সরদার ফজলুল করিম ১৯২৫ সালে বরিশালের এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে বাবার সঙ্গে হালচাষ করেছেন। ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র। চল্লিশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগ থেকে শিক্ষা পর্ব শেষে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তি পেয়েছিলেন বিদেশ যাওয়ার। তবে শিক্ষকতা, উচ্চশিক্ষা বৃত্তি—সবই তিনি ত্যাগ করেছিলেন মানবমুক্তির লক্ষ্যে শ্রেণিহীন সমাজ গঠনের জন্য বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে। পাকিস্তান আমলে কারারুদ্ধ থেকেছেন দীর্ঘ ১১ বছর। পরে বাংলা একাডেমিতে কাজ করেছেন এবং স্বাধীনতার পরে জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের বিশেষ আগ্রহে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনায় যোগ দেন। পরে জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে সম্মানিত হয়েছে। আমৃত্যু জাতীয় জীবনের প্রতিটি সংকটময় মুহূর্তে যথার্থ বুদ্ধিজীবীর ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। সমাজ ও দর্শন নিয়ে মৌলিক ভাবনার গ্রন্থ রচনাসহ প্লেটো, অ্যারিস্টটল, রুশো, অ্যাঙ্গেলসের বহু গ্রন্থ এবং ইউরোপীয় দর্শনের বহু কালজয়ী গ্রন্থের তিনি অনন্য অনুবাদ করেছেন।
আজকের স্মরণসভায় প্রচলিত ধারার কোনো সভাপতি বা প্রধান অতিথি ছিলেন না। আলোচনা সাজানো হয়েছিল তিনটি পর্বে। মূলত তরুণ প্রজন্মের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা কীভাবে সরদারের চর্চা করছেন, তার ওপরই জোর দেওয়া হয়েছিল। প্রথম পর্বে ছিল প্রবীণদের আলোচনা। এই পর্বে প্রাবন্ধিক ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হক বলেন, সমাজের অনেক অনুষঙ্গ সময়ের সঙ্গে বদলাবে, তবে সরদার ফজলুল করিমের ভাবনার প্রাসঙ্গিকতা থেকে যাবে। কারণ, তিনি কাজ করে গেছেন মানবতার জন্য। সারা বিশ্বেই মানবতা এখন গভীর সংকটে রয়েছে।
মফিদুল হক বলেন, ‘সরদার পাকিস্তানের কঠিন শাসনের মধ্যে কেমন করে তাঁর আদর্শিক অবস্থান ধরে রেখেছেন, তা এখনকার প্রজন্ম কল্পনাও করতে পারবে না। শাসকেরা শুধু কারা নির্যাতনই নয়, বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িতদের সমগ্র জীবনটাকেই দুমড়েমুচড়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সরদার তাঁর আদর্শ থেকে বিচ্যুত হননি। সরদার গণমানুষের জন্য শোষণহীন সমাজ নির্মাণের পথে অগ্রসর হয়েছিলেন। তাঁর জীবনসংগ্রাম ও আদর্শের ভেতর দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে তাকালে অনেক বড় পরিসরে সেই ইতিহাস দেখতে পাব।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, খেয়েপরে বেঁচে থাকা মানুষের জীবন নয়। মানুষ স্বপ্ন দেখে এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে চায়। এটাই মানুষের জীবন। সরদার ফজলুল করিম এমনই একটি মানবসমাজের ভাবনা দিয়ে গেছেন, তার পথ দেখিয়ে গেছেন। তিনি তাঁর মানুষ পরিচয়টিকেই সব সময় প্রাধান্য দিয়েছেন। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে তাঁর চিন্তার প্রসার ঘটাতে হবে।
সাবেক সচিব ও লেখক এ কে এম আবদুল আওয়াল মজুমদার বলেন, তাঁর গৌরব যে তিনি সরদার ফজলুল করিমের সরাসরি ছাত্র ছিলেন। তিনি তাঁর শিক্ষকের ব্যক্তিজীবনের বিনয়, সদাচার, অতি সাধারণ জীবনযাপনের দিকগুলো তুলে ধরেন। তিনি বলেন, যে আদর্শ ও ন্যায়ের শিক্ষা তিনি তাঁর শিক্ষকের কাছে পেয়েছেন, চাকরিক্ষেত্রে এবং সারা জীবনে তা অনুসরণ করেছেন, তাঁর সন্তানদের মধ্যেও সেই আদর্শ অনুসরণের অনুপ্রেরণা দিয়েছেন।
আরও আলোচনা করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম, লেখক কাজী মোহাম্মদ শীষ ও নায়েমের উপপরিচালক স্বপন কুমার নাথ। উপস্থিত ছিলেন কথাসাহিত্যিক মশিউল আলমসহ অনেকে।
দ্বিতীয় পর্বে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষকেরা তাঁদের আলোচনায় ব্যক্তিজীবনের বিভিন্ন সংকট উত্তরণে সরদার ফজলুল করিমের সুচিন্তিত মতামত ও প্রজ্ঞাবান পরামর্শগুলোর ওপরে জোর দেন। আলোচনায় অংশ নেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক নিবেদিতা রায় ও শরীফ নুরজাহান এবং জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মাসুদুর রহমান।
আলোচকেরা বলেন, সরদার ফজলুল করিম সব সময় বলেছেন, জীবন জয়ী হবেই। আদর্শহীনতা, ভয়—এসব হতাশার জন্ম দিতে পারে। এগুলো ব্যক্তিজীবনেরই অংশ। তাই পথ থেকে সরে গেলে চলবে না। আলোর সন্ধান করতে হবে। জীবনকে অনুসন্ধান করতে হবে। জীবনবোধে উদ্দীপ্ত হতে হবে। এগিয়ে চলাই নিয়তি। তরুণ শিক্ষকেরা তাঁদের শিক্ষার্থীদের মধ্যেও সরদারের এই গভীর মানবতাবাদী আশাবাদকে সঞ্চারিত করতে চেয়েছেন।
তৃতীয় পর্বে ছিল বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে শিক্ষার্থীদের সরদার ফজলুল করিম চর্চা প্রসঙ্গ। এ পর্যায়ে তাঁরা সরদার ফজলুল করিমের বিভিন্ন বই পড়ার অভিজ্ঞতা, তাঁর জীবন ও কর্ম নিয়ে নিজেদের উপলব্ধির কথা তুলে ধরেন। তাঁরা বলেছেন, সরদার ফজলুল করিম মনে করতেন, সমাজ পরিবর্তন করতে হলে মানুষকে পরিবর্তন করতে হবে। তিনি সেই পরিবর্তনের পথ দেখিয়ে গেছেন। একটি মানবিক সমাজ গঠন করতে হলে তাঁর মতো মনীষীদের ভাবনা অনুসরণ করতে হবে।
এ পর্যায়ে আলোচনা করেন রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী মো. আজম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আরাফাত ইমরান, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শারমিন সুলতানা, ইতিহাসের নাইমুর রহমান ও দর্শনের জিন্নাত আরা, ইডেন মহিলা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের মারুফা প্রীতি ও ব্যবস্থাপনা বিভাগের ফৌজিয়া রীতা।
আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে বাঁশি বাজিয়ে শোনান এস এম মকবুল হোসেন ও আবৃত্তি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আবৃত্তি সংসদ। সঞ্চালনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শান্তনু মজুমদার।