আধা পাকা জুমের ধান কেটে চুলায় শুকিয়ে ধান মাড়াই করছেন দুই ম্রো নারী। সম্প্রতি থানচির রেমাক্রীর বুলু পাড়ায়।
আধা পাকা জুমের ধান কেটে চুলায় শুকিয়ে ধান মাড়াই করছেন দুই ম্রো নারী। সম্প্রতি থানচির রেমাক্রীর বুলু পাড়ায়।

থানচির দুর্গম এলাকায় খাদ্যাভাব থাকতে পারে আরও দুই সপ্তাহ

বান্দরবানের থানচি উপজেলার দুর্গম লেইক্রি এলাকায় কিছু পরিবারে খাদ্যঘাটতি থাকলেও কোনো পরিবার না খেয়ে নেই। কয়েক দফা ত্রাণ বিতরণ করায় সংকটে পড়া পরিবারগুলো এখন অনাহারে নেই। তবে সেখানে এখনো পর্যাপ্ত খাবারও নেই। জুমের ধান পাকবে আরও ১২ থেকে ১৫ দিন পর। সে পর্যন্ত ত্রাণ সরবরাহ করা জরুরি বলে জানিয়েছেন সেখানকার লোকজন ও জনপ্রতিনিধি।

থানচি উপজেলা সদর থেকে শতাধিক কিলোমিটার দূরে মিয়ানমারের সীমান্তসংলগ্ন এলাকাগুলোতে খাদ্যঘাটতির সংবাদ পাওয়া যায় চলতি মাসে শুরুতে। যোগাযোগবিচ্ছিন্ন ওই এলাকার লেইক্রি, বুলুপাড়া, পানঝিরি, মেনহাতপাড়াসহ ছোট ছোট ১৯টি পাড়ায় বসবাসরত ৩১৯টি পরিবারের প্রায় অর্ধেকই খাদ্যসংকটে পড়ে বলে সংবাদে জানা যায়। তাঁদের মধ্যে কোনো কোনো পরিবার মে-জুন থেকে কষ্টে ছিলেন। জুলাই-আগস্টে বনের আলু ও বাঁশকোড়ল খেয়ে দিন কাটান বলে ওই এলাকাবাসী থেকে জানা গেছে।

রেমাক্রি ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মাং চং ম্রো জানিয়েছেন, মূলত দুর্গম যোগাযোগ ও থানচির ব্যাংক ডাকাতির ঘটনার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে খাদ্যঘাটতি দেখা দেয়। তিনি বলেন, ইউনিয়নের ৬ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ড সাঙ্গু সংরক্ষিত বনাঞ্চলে পড়েছে। সাঙ্গু নদের উজানে নৌকাযোগে যাওয়া ছাড়া এলাকাগুলো সব ধরনের যোগাযোগবিচ্ছিন্ন। দুটি ওয়ার্ডে ১৯টি পাড়ায় ৩১৯টি পরিবারের জনসংখ্যা প্রায় ১ হাজার ৬০০। এদের মধ্যে ১৭০টির মতো অতিদরিদ্র পরিবার মৌসুমি খাদ্যঘাটতিতে বেশি সংকটে পড়েছে।

রেমাক্রি ইউনিয়নে অবস্থিত লেইক্রি এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে আরাকান পাহাড়ে সাঙ্গু নদের উৎপত্তিস্থলে মেনহাত ম্রোপাড়া, বুলুপাড়া, ডলুঝিরি, থাংকোয়াইপাড়া ও পানঝিরি—এই পাঁচটি পাড়ায় খাদ্যসংকটে পড়া পরিবার বেশি। মেনহাতপাড়ার মং এচং ম্রো বলেছেন, এপ্রিল থেকে খাদ্যঘাটতি শুরু হয়েছিল। কিন্তু মে-জুন পর্যন্ত মোটামুটি কিছু খেয়ে না খেয়ে চলেছে। জুলাইয়ে বৃষ্টি শুরুর পর আগস্ট পর্যন্ত তাঁদের পাড়ার ১৪টি পরিবার শুধু বনের আলু, বাঁশকোড়ল খেয়ে দিন কাটিয়েছে।

বুলুপাড়ার কার্বারি (পাড়াপ্রধান) বুলু ম্রো জানিয়েছেন, দুই মাস ভাত না খেয়ে থাকার পর চলতি মাসের (সেপ্টেম্বর) শুরুতে পর্যাপ্ত না হলেও সরকারি-বেসরকারি কিছু ত্রাণ পেয়েছেন। তখন থেকে ভাত খেতে পারছেন। এখন কারও কারও জুমে আগে বপন করা ধান পেকে উঠেছে। ওই ধান পাতিলে ভরে চুলার আগুনে শুকিয়ে চাল করে কষ্টে দিন কাটাতে হচ্ছে। জুমের ধান পাকা পর্যন্ত আরও ১২ থেকে ১৫ দিনের জন্য ত্রাণ জরুরি বলে বুলু কার্বারি জানিয়েছেন।

রেমাক্রি ইউপি সদস্য মাং চং ম্রো বলেন, যোগাযোগবিচ্ছিন্ন এলাকার দরিদ্র জুমচাষিদের মৌসুমি খাদ্যঘাটতি একটি চিরায়ত সমস্যা। অনেকটা একসময়ের উত্তরবঙ্গের কার্তিকের মঙ্গার মতো। এপ্রিল-মে মাসে জুমের উৎপাদিত ধান-চালের মজুত শেষ হয়ে যায়। জুমের পরবর্তী ফসল বা ধান না পাওয়া পর্যন্ত তাঁদের এই অভাব চলে। থানচির দুর্গম রেমাক্রি ইউনিয়নে প্রতিবছর এই সমস্যা কমবেশি মেটাতে হচ্ছে বলে তিনি জানিয়েছেন।

আধা পাকা জুমের ধান কেটে চুলায় শুকিয়ে ধান মাড়াই করছেন এক ম্রো নারী। সম্প্রতি থানচির লেইক্রি এলাকা থেকে তোলা

থানচি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মামুন জানিয়েছেন, এ পর্যন্ত সরকারিভাবে দুই টন ও বেসরকারিভাবে পাঁচ টন চাল লেইক্রি এলাকার বিভিন্ন পাড়ায় পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এ জন্য সেখানে কিছু অভাব থাকলেও কেউ না খেয়ে নেই। কয়েক দিনের মধ্যে জুমের ধান পাকলে আর কোনো সমস্যা থাকবে না।