সিজিএসের প্যানেল আলোচনা

ভূরাজনীতিতে এশিয়া এখন আন্তর্জাতিক উত্তেজনার কেন্দ্রে

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) আয়োজিত ‘বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন ২০২৪’ (বঙ্গোপসাগর সংলাপ)-এর প্যানেল আলোচনায় বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা, ১৭ নভেম্বর
ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলসহ বিশ্বের নানা প্রান্তে চীনকে মোকাবিলা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা নানা উদ্যোগ নিয়েছে। আর যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ দেখতে গিয়ে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে ইউরোপে। ভূকৌশলগত প্রতিযোগিতার রাজনীতির কারণে এশিয়া এখন আন্তর্জাতিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

রাজধানীর একটি হোটেলে তিন দিনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনের প্যানেল আলোচনায় গতকাল রোববার বিশেষজ্ঞরা এ কথা বলেন। বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) ‘বে অব বেঙ্গল কনভারসেশন ২০২৪’ (বঙ্গোপসাগর সংলাপ)-এর আয়োজন করেছে।

‘পাওয়ার শিফটস: দ্য জিওপলিটিক্যাল চেজবোর্ড ইন এ ফ্র্যাকচার্ড ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক প্যানেল আলোচনায় বক্তৃতা করেন নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের (বিআইপিএসএস) প্রেসিডেন্ট মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক কৌশলগত প্রতিযোগিতার ভরকেন্দ্র এখন ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল। ভূকৌশলগত পুনঃভারসাম্যের নামে যুক্তরাষ্ট্র তার ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় কৌশল (আইপিএস) গ্রহণ করেছে। ভারত ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে কৌশলগত যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল, বাস্তবে তা এখন প্রতিরোধের তত্ত্বে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেন, এটা করতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্ররা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যার মূলে রয়েছে কোয়াড (যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ভারত ও জাপানের জোট) এবং অকাসের (অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের জোট)’ মতো উদ্যোগ। এর প্রধান লক্ষ্য চীনের শক্তি ও প্রভাব প্রতিহত করা।

আ ন ম মুনীরুজ্জামানের মতে, সেমিকন্ডাক্টরস (ইলেকট্রনিক যন্ত্র তৈরিতে ব্যবহৃত বিশেষ উপাদান), রোবোটিকস এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ক্ষেত্রে চীনকে রুখে দিতে প্রযুক্তির লড়াই শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা। বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থা থেকে চীনকে হটিয়ে দিতে শিল্পকারখানা দেশটির বাইরে নিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মধ্যেই ভারতে বেশ কিছু শিল্প নিতে শুরু করেছে। চীনের বাইরে থেকে শিল্পের স্থানান্তর বাংলাদেশে হওয়ার সুযোগ আছে। সব মিলিয়ে ভূকৌশলগত প্রতিযোগিতার প্রেক্ষাপটে এশিয়া এখন আন্তর্জাতিক উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

দক্ষিণ এশিয়ার চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির প্রসঙ্গ টেনে সাবেক জ্যেষ্ঠ এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, চীন দ্রুততার সঙ্গে এই অঞ্চলে নিজের অবস্থান করে নিয়েছে। ভারত ছাড়া এখানকার সব দেশের সর্ববৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার চীন। ভারত ছাড়া সবাই বিআরআই (অঞ্চল ও পথের উদ্যোগ) সই করে অবকাঠামো খাতে সহায়তা নিশ্চিত করেছে। অর্থাৎ চীনের বিশেষ কূটনীতি এখানে যথেষ্ট কার্যকর হয়েছে। তিনি বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার বেশি জনসংখ্যার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ভারত একধরনের অস্বস্তিতে আছে। চীন এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজের সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ করার সুযোগ পাচ্ছে।

ভারতের সাবেক কূটনীতিক ও ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বলেন, অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠতার সরলীকরণ করে চীনকে প্রতিরোধের বিষয়টি টেনে আনেন। কোয়াডে যুক্ততার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারতের নিবিড় অংশীদারত্ব আছে। আবার সীমান্তে সংঘাত থাকলেও চীনের সঙ্গে ব্যবসা–বাণিজ্যসহ নানাভাবে যুক্ততা রয়েছে ভারতের।

ভারত সবার সঙ্গেই যুক্ত থাকতে চায় উল্লেখ করে শ্রীরাধা বলেন, বহুমাত্রিক নীতি অনুসরণের ধারাবাহিকতায় কৌশলগত কারণে একদিকে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমের সঙ্গে রয়েছে ভারত; আবার জাতীয় স্বার্থে অর্থনীতি ও বিনিয়োগের মতো বিষয়গুলোকে বিবেচনায় রেখে যুক্ত আছে চীনের সঙ্গেও।

চীনকে প্রতিহত করতে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা উদ্যোগে ভারতের সায় আছে, এ নিয়ে সমালোচনাও রয়েছে—এ প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের উত্তরে শ্রীরাধা দত্ত বলেন, ‘এটা ঠিক যে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের উপস্থিতি দৃশ্যমান। আমি মনে করি, দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলো ভারতকে ঘৃণা করতে পছন্দ করে।’ তিনি বলেন, চীনের সঙ্গে মালদ্বীপের রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতা অজানা নয়। তারপরও দেশটির অর্থনৈতিক সংকটে এগিয়ে এসেছে ভারত। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটের সময় ভারত ৪৫০ কোটি ডলার দিয়েছে। নেপালে তো চীন মুখে মুখেই সহযোগিতা দিয়ে গেছে। ভারতের সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর সমস্যা আছে। এটা তো অস্বীকার করার কারণ নেই যে এই অঞ্চলে সবাই চীনের সঙ্গে কাজ করতে চায়।

লাটভিয়ার তুরিবা বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক গ্রেগরি সাইমন্স বলেন, ইউরোপে একধরনের বিশৃঙ্খলা চলছে। এর বড় কারণ হচ্ছে এরা সবাই যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থেই কাজ করছে। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাখোঁসহ ইউরোপের নেতারা ২০১৬ সালের মতো এবারও যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের বিরোধিতা করেন। তাঁরা এতটাই অন্ধ ছিলেন যে আবারও ভুল করলেন। এটাই ইউরোপের সমস্যা।

গ্রেগরি সাইমন্সের মতে, ইউরোপ স্বাধীন ও স্বতন্ত্র কোনো কৌশলগত শক্তি হিসেবে নয়; বরং যুক্তরাষ্ট্রের এজেন্ট হয়ে কাজ করছে। তাই তারা ইউক্রেন যুদ্ধ থামাতে কিংবা ফিলিস্তিনে গণহত্যা বন্ধে কোনো অবস্থান নিতে পারে না। ইউরোপের দেশগুলো সারা বিশ্বকে মূল্যবোধের দীক্ষা দিতে থাকে। অথচ তাদের দেশের নেতৃত্বের মধ্যে সেটার চরম অনুপস্থিতি। আসলে তারা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক স্বার্থই চরিতার্থ করতে চাইছে। তারা যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এতটাই নির্ভরশীল যে একান্ত বাধ্য ছাত্রের মতো আচরণ করছে।

ভারতের ‘প্রতিবেশী প্রথম’ নীতি কেন ব্যর্থ হয়েছে জানতে চাইলে শ্রীরাধা দত্ত বলেন, ‘এই নীতি ব্যর্থ হয়নি। কখনো কখনো সময় আসে যখন আমরা প্রতিবেশীকে ঠিকমতো বুঝতে পারি না। এটা অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই। অনেক বিষয় আমরা শুধরে নিয়েছি।’

সিজিএসের জ্যেষ্ঠ গবেষণা ফেলো পারভেজ করিম আব্বাসীর সঞ্চালনায় আলোচনায় আরও অংশ নেন চীনের জিলিন ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আমনা খান এবং দ্য এশিয়া ফাউন্ডেশনের এ দেশীয় প্রতিনিধি কাজী ফয়সল বিন সিরাজ।