সংসারে ব্যয়ের চাপে কাটছাঁট ইন্টারনেটে

ইন্টারনেট গ্রাহক, ফেসবুক ব্যবহারকারী ও স্মার্টফোন উৎপাদন কমেছে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া ‘বড়’ কারণ।

ইন্টারনেট

দেশে ছয় মাস ধরে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী কমছে। কমেছে স্মার্টফোন উৎপাদন। একইভাবে কমেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের ব্যবহারকারী।

কমার এই প্রবণতা এমন একটা সময়ে দেখা যাচ্ছে, যখন দেশে নিত্যপণ্য ও সেবার দাম ব্যাপকভাবে বেড়েছে। সব মিলিয়ে বেড়েছে জীবনযাত্রার ব্যয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ব্যয় বাড়লেও মানুষের আয় সেভাবে বাড়ছে না। ফলে সংসারের ব্যয় কমাতে সাধারণ মানুষ যেসব খাতে কাটছাঁট করছেন, তার একটি ইন্টারনেট।

বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) হিসাবে, গত জুলাইয়ে দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিল প্রায় ১২ কোটি ৭৬ লাখ, যা ডিসেম্বরে কমে ১২ কোটি ৪৪ লাখে নামে। অর্থাৎ কমেছে ৩২ লাখ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের গ্রাহকসংখ্যা তুলে ধরা ওয়েবসাইট নেপোলিয়নক্যাটের তথ্য বলছে, বিগত সাত মাসে বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারী কমেছে সোয়া কোটির মতো। এদিকে বিটিআরসির হিসাবে, গত ডিসেম্বরে দেশে স্মার্টফোন উৎপাদিত হয়েছে তিন লাখের কিছু বেশি, যা আগস্টেও ৮ লাখ ছিল।

কমতির ধারার সঙ্গে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়া ও জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক আছে কি না, জানতে চাইলে টেলিযোগাযোগ খাতের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান লার্নএশিয়ার জ্যেষ্ঠ পলিসি ফেলো আবু সাঈদ খান প্রথম আলোকে বলেন, ইন্টারনেট ব্যবহার কমে যাওয়া সরাসরি মানুষের আয় পরিস্থিতির সঙ্গে সংযুক্ত। ইন্টারনেট ব্যবহার না করলে মানুষের জীবনযাত্রা অচল হয়ে যাবে, বাংলাদেশ এখনো সেই পর্যায়ে পৌঁছায়নি। ফলে মানুষ ব্যয় কমাতে অন্য আরও উপায়ের সঙ্গে ইন্টারনেট ব্যবহার কমানোকে বেছে নিচ্ছে। তিনি বলেন, দেখতে হবে, মোবাইল ইন্টারনেটের ব্যবহার কমার বিপরীতে ব্রডব্যান্ডের ব্যবহার কী দাঁড়াল।

দেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা দেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো আইএসপি (ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার) নামে পরিচিত। এদের সংগঠন ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (আইএসপিএবি) সভাপতি এমদাদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, তাদের গ্রাহক এখনো কমেনি। তবে বৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে গেছে। কারণ, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইন্টারনেট সেবা দেওয়ার সরঞ্জামের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাঁদের খরচ বেড়েছে। আরেকটি কারণ হতে পারে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া।

মুঠোফোনে ইন্টারনেটে ভাটা

কোনো ব্যক্তি ৯০ দিনের মধ্যে এবার ইন্টারনেট ব্যবহার করলেই তাঁকে গ্রাহক হিসেবে ধরে বিটিআরসি। সংস্থাটির হিসাবে, গত জুলাই মাসে দেশে মুঠোফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ছিল ১১ কোটি ৬৪ লাখ। সংখ্যাটি ৩৯ লাখ কমে ডিসেম্বরে ১১ কোটি ২৬ লাখে নেমেছে। বিপরীতে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গ্রাহক বেড়েছে ৮ লাখের মতো। সংখ্যা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ কোটি ১৯।

কেউ কেউ মনে করেন, বিটিআরসি ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর যে হিসাব তুলে ধরে তাতে প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না। কারণ, ইন্টারনেট সেবাদাতা অনেক। বড় অংশ অবৈধ। তাদের কাছ থেকে তথ্য পাওয়া কঠিন। সব মিলিয়ে বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর যে সংখ্যা তুলে ধরা হয়, তাতে জনসংখ্যার কত শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহার করে, তা উঠে আসে না। কিন্তু একটি প্রবণতা বোঝা যায়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ২০২২ সালের জনশুমারির প্রাথমিক প্রতিবেদন বলছে, দেশের পাঁচ বছরের বেশি বয়সী জনসংখ্যার প্রায় ৩১ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী।

মোবাইল অপারেটরগুলোর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ইন্টারনেট গ্রাহক কমার কারণ দুটি। একটি হলো, একাধিক সিম ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করতে নেওয়া নানা পদক্ষেপ। অন্যটি হলো, মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়া। একটি অপারেটরের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে বলেন, প্রতি মাসে যাঁরা ৩০০ টাকা পর্যন্ত ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, তাঁদের সংখ্যা কমেছে। বিপরীতে যাঁরা ইন্টারনেটের পেছনে এর চেয়ে বেশি টাকা ব্যয় করেন, তাঁদের সংখ্যা বেড়েছে। সব মিলিয়ে ইন্টারনেট থেকে তাঁদের রাজস্ব বেড়েছে।

দেশের শীর্ষ অপারেটর গ্রামীণফোনের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য বলছে, ২০২২ সালের জুলাই–সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে গ্রাহকপ্রতি ডেটার ব্যবহার বেড়েছে আগের প্রান্তিকের তুলনায় ৮ শতাংশের বেশি। পরের প্রান্তিকে (অক্টোবর–ডিসেম্বর) তেমন কোনো প্রবৃদ্ধি হয়নি। ফলে দেখা যাচ্ছে, গ্রাহকপ্রতি ব্যবহারেও একটা ভাটার টান এসেছে।

উল্লেখ্য, গত ছয় মাসে অপারেটরগুলো ইন্টারনেট প্যাকেজের দামও বাড়িয়েছে। আবার ২০ টাকার নিচে এখন মুঠোফোনে টাকা ভরা যায় না, যা আগে ১০ টাকা ছিল।

ফেসবুক ব্যবহারকারী কমেছে

নেপোলিয়নক্যাটের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে গত জুলাইয়ে ফেসবুক ব্যবহারকারী ছিল ৫ কোটি ৮৯ লাখ। জানুয়ারি মাসে তা কমে ৪ কোটি ৬৫ লাখে নামে। সাত মাস ধরে বাংলাদেশে ফেসবুক ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমছে।

নেপোলিয়নক্যাট ছাড়াও ডাটারিপোর্টাল নামের একটি প্রতিষ্ঠানও ফেসবুক ব্যবহারকারী কমার তথ্য তুলে ধরছে। তাদের হিসাবে, বাংলাদেশে ফেসবুকে বিজ্ঞাপনদাতারা যতসংখ্যক ব্যবহারকারীর কাছে পৌঁছাতে পারত, সেই সংখ্যা গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি বছরের জানুয়ারির মধ্যে ৩৭ লাখ কমে গেছে।

ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা আরও দুটি সেবা দেয়—ইনস্টাগ্রাম ও মেসেঞ্জার। এই দুই সেবার ব্যবহারকারীর সংখ্যাও কমছে। নেপোলিয়নক্যাটের তথ্যমতে, সাত মাসে ইনস্টাগ্রাম ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ৭ লাখ কমেছে। এখন সেবাগ্রহীতা দাঁড়িয়েছে ৪৭ লাখ। আর মেসেঞ্জার ব্যবহারকারীর সংখ্যা কমেছে ১ কোটির বেশি। সংখ্যাটি দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৪২ লাখ।

পেশাজীবীদের জন্য সামাজিক যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম লিংকডইনের ব্যবহার এমনিতেই বাংলাদেশে কম। গত জুলাইয়ে সেবাটির বাংলাদেশি ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৫৩ লাখের বেশি ছিল। কিন্তু জানুয়ারিতে তা ১৮ লাখে নামে।

তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, করোনাকালে সময় কাটানোর জন্য মানুষ অনেক বেশি ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল ছিল। ক্লাসও অনলাইনে হতো। এখন স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফেরার পর মানুষের সেই চাহিদা হয়তো আগের মতো নেই। তিনি আরও বলেন, অর্থনৈতিক সংকটও ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।

স্মার্টফোনের উৎপাদনও কমেছে

বিটিআরসির তথ্য অনুযায়ী, স্মার্টফোন (ফোর–জি) উৎপাদনও ধারাবাহিকভাবে কমছে। গত আগস্টে দেশে ৮ লাখের বেশি স্মার্টফোন উৎপাদিত হয়েছিল। এরপর কমতে কমতে ডিসেম্বরে তা প্রায় তিন লাখে নামে।

কারণ কী, জানতে চাইলে দেশে মুঠোফোন উৎপাদনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ মোবাইল ফোন ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ট্রানশান বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) রিজওয়ানুল হক প্রথম আলোকে বলেন, বছরের চতুর্থ ভাগে সাধারণত চাহিদা কম থাকে। এ ছাড়া সাম্প্রতিক পরিস্থিতিতে স্মার্টফোনের চাহিদা ৪০ শতাংশের মতো কমেছে। চাহিদা কম থাকলে উৎপাদন স্বাভাবিকভাবেই কমবে। তিনি বলেন, মার্কিন ডলার–সংকটের কারণে কাঁচামাল আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় ঋণপত্র খোলা যাচ্ছে না।

দ্রব্যমূল্যের চাপ

দেশে ২০২২ সালের শেষ ছয় মাসে নিত্যপণ্য ও সেবার দাম ব্যাপকভাবে বেড়েছে। মূল্যস্ফীতি এ সময় ৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, যা ছিল ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) মাসে মাসে ‘বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তা ও বিপন্নতা পর্যবেক্ষণ’ শিরোনামের একটি জরিপ করে। এতে উঠে আসে যে বাংলাদেশের মানুষের কাছে সবচেয়ে বড় আঘাত দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়া। এরপে ছিল স্বাস্থ্য ব্যয় এবং কাজ হারানো অথবা আয় কমে যাওয়া। ডিসেম্বরের জরিপে এসেছে, ৪৮ শতাংশ পরিবার দ্রব্যমূল্যের কারণে বেড়ে যাওয়া ব্যয় সামলাতে নানা কৌশল নিয়েছে। কেউ খাবার কম খাচ্ছে, কেউ অন্য খাতে ব্যয় কমিয়েছে।

শুধু নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে, তা নয়। সরকারও গ্যাস, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি তেলের দাম দফায় দফায় বাড়িয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সংসারের ব্যয় বেড়ে গেলে, বিপরীতে আয় না বাড়লে মানুষ সহজে ব্যয় কমানোর পথগুলো খুঁজে নেয়। সে ক্ষেত্রে ইন্টারনেটে ব্যয় কাটছাঁট একটি উপায়। তবে সরকার যখন স্মার্ট বাংলাদেশ গঠনের কথা বলছে, তখন এই প্রবণতা ভালো লক্ষণ নয়। ইন্টারনেটের ব্যবহার দেশে বাড়ানো দরকার এবং এটার ব্যবহার যাতে জরুরি হয়, সেই উপযোগিতাও তৈরি করতে হবে।

বেসরকারি চাকরিজীবী গোলাম সামদানি প্রথম আলোকে বলেন, মাস ছয়েক আগেও তিনি মুঠোফোনে প্রতি মাসে ৩০০ টাকার ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনতেন। এখন জরুরি প্রয়োজন হলে তিন দিনের ছোট প্যাকেজ কেনেন। অন্য সময় ব্যবহার করেন না। তিনি বলেন, শুধু ইন্টারনেট নয়, আরও কিছু খাতে ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। কারণ, নিত্যপণ্যের দাম, পরিবহন, রান্নার গ্যাস, সন্তানের স্কুলের বেতনসহ নানা খাতে ব্যয় বেড়েছে।