প্রথম আলোর অনুসন্ধান

সেই জজ মিয়া ‘তারকা সন্ত্রাসী’!

২০০৪ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী এবং তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে চালানো গ্রেনেড হামলা ছিল বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের অন্যতম কলঙ্কজনক অধ্যায়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই হত্যাচেষ্টার মামলা নিয়ে গড়িমসি চলে। তৎকালীন সরকার নানা উপায়ে তদন্তও বিপথে নেয়। প্রতিষ্ঠার পর ২৫ বছর ধরে প্রথম আলো অনবরত অনুসন্ধান করে চলেছে সমসাময়িক ইতিহাসের চাপা দেওয়া ঘটনার পেছনের সত্য। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা তার অন্যতম। প্রথম আলোর মহাফেজখানা থেকে সে অনুসন্ধানের কিছু নির্বাচিত অংশ পাঠকদের জন্য পেশ করা হলো।

গ্রেনেড কী জিনিস জীবনেও দেখেননি জজ মিয়া। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে গিয়ে নিজেই বলেছেন, বোমা ও গ্রেনেডের পার্থক্য তিনি জানেন না। থানা-পুলিশ বলেছে, জজ মিয়া নিরপরাধ মানুষ, তার নামে থানায় কোনো মামলা নেই। সেই জজ মিয়া ২১ আগস্টে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে হামলার ঘটনায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার সুবাদে রীতিমতো তারকা সন্ত্রাসীতে পরিণত হয়েছেন।

এদিকে মগবাজার এলাকার সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার মোখলেছুর রহমানের ছেলে ব্যারিস্টার মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেছেন, সিআইডি পুলিশ গ্রেনেড হামলায় তার বাবাকে জড়াতে না পেরে সাক্ষী হওয়ার জন্য চাপ দেয়। কিন্তু তার বাবা তাতে রাজি হননি। পুলিশের ভাষ্যমতে, জজ মিয়ার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সিআইডি তাকে গ্রেপ্তার করেছিল।

জজ মিয়ার মা জোবেদা খাতুন প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকায় ভিডিও দোকানে কাজ করার সময় কিছু ছিঁচকে চোরের সঙ্গে তার শত্রুতা হয়। তারাই তার সন্তানকে গ্রেনেড নিক্ষেপকারী বলে ধরিয়ে দিয়েছে। আর সিআইডি সেই সুযোগটি কাজে লাগিয়েছে।

১৫ দিন সিআইডি পুলিশের হেফাজতে থাকার পর গত রোববার বঙ্গবন্ধু এভিনিউর গ্রেনেড হামলার মামলায় ‘স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি’ দিয়েছেন জজ মিয়া। সিআইডি পুলিশের কর্মকর্তা ফোন করে সেই জবানবন্দির বৃত্তান্ত সাংবাদিকদের জানান। তবে এর আগে জজ মিয়ার বক্তব্য সরকার সমর্থক পত্রিকাগুলোর কাছে সরবরাহ করা হয়। একটি দৈনিকে তা হুবহু ছাপা হয়।

সিআইডির বিশেষ সুপার রুহুল আমিন গত রোববার প্রথম আলোকে বলেন, জজ মিয়াকে ইন্টারপোল কর্মকর্তাদের সামনে হাজির করা হলে তারা তার বক্তব্যে সন্তুষ্ট হন। এরপরই তার জবানবন্দি নেওয়া হয়। তবে ইন্টারপোল কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাংবাদিকদের কোনো কথা বলতে দেওয়া হয়নি। গ্রেনেড মামলার তদারককারী রুহুল আমিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে পরিবারের পক্ষ থেকে বলা হয়, তিনি সিঙ্গাপুর গেছেন। সিআইডির ডিআইজি শামসুল ইসলাম কোনো কথাই বলতে চাননি।

সূত্র জানায়, র‍্যাবের হাতে শীর্ষ সন্ত্রাসী আরমান ধরা পড়ার পর জজ মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে জজ মিয়ার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী রাজধানীর মগবাজার থেকে গ্রেপ্তার করা হয় আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক ওয়ার্ড কমিশনার মোখলেছুর রহমানকে।

তাকে সিআইডি দু দফা রিমান্ডে নিয়ে জেরা করে। মোখলেছকে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে সিআইডির পক্ষ থেকে বলা হয়, মোখলেছ গ্রেনেড হামলায় জড়িত রয়েছেন এবং জজ মিয়াকে চেনেন। মোখলেছ ও আরমানকে জড়িয়ে নানা খবরও প্রকাশিত হয়। সিআইডির কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন জজ মিয়া, আরমান ও মোখলেছকে মুখোমুখি করা হবে।

মোখলেছের ছেলে ব্যারিস্টার মশিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, তার বাবার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ সত্য নয়। কারাগারে আটক তার বাবা জানিয়েছেন, সিআইডি হেফাজতে থাকা অবস্থায় জজ মিয়াকে তার সামনে আনা হয়েছিল। কিন্তু তিনি তাকে চিনতে পারেননি। এরপর সিআইডির কর্মকর্তারা তাকে আসামি না হয়ে মামলার সাক্ষী হওয়ার জন্য অনুরোধ করেন।

তিনি বলেন, এ ঘটনার তিনি কিছুই জানেন না, সাক্ষী হবেন কী করে? এরপর সিআইডি তাকে কারাগারে পাঠায়। মোখলেছুর রহমান তার ছেলের কাছে বলেন, সিআইডি হেফাজতে তাকে শুধু সাক্ষী হওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করা হয়েছে। তিনি রাজি না হওয়ায় তাকে হুমকিও দেওয়া হয়। তবে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির এএসপি আবদুর রশিদ এ কথা অস্বীকার করেছেন।

ব্যারিস্টার মশিউর জানান, এ ঘটনায় এর আগেও তার বাবাকে র‍্যাব ধরে নিয়ে যায়। তবে তারা ৬-৭ ঘণ্টা পর আবার তাকে বাসায় পাঠিয়ে দেন। র‍্যাব হেফাজতে তাকে বারবার বলা হয়, আরমানকে চেনেন কি না। তিনি বলেন, আরমানকে চিনি, কিন্তু তার কোনো সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কিছু জানি না।

সূত্র জানায়, সিআইডি কর্মকর্তা গ্রেনেড হামলার ষড়যন্ত্রের স্থান হিসেবে তার বাড়িটি উল্লেখ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মোখলেছ সাক্ষী না হওয়ার কারণে তা সম্ভব হয়নি।

আমাদের সেনবাগ (নোয়াখালী) প্রতিনিধি মাহবুবুর রহমান জানান, নোয়াখালীর সেনবাগে জজ মিয়ার গ্রামের লোকজন বিশ্বাসই করতে পারছেন না, তার মতো সহজ-সরল যুবক গ্রেনেড হামলার মতো ভয়াবহ ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকতে পারে। সেনবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কাজেমুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, তার নামে থানায় কোনো অপরাধের রেকর্ড নেই। তিনি নিরপরাধ মানুষ।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেনবাগ উপজেলার বোকারপাড় ইউনিয়নের বীরকোট গ্রামের মৃত আবদুর রশিদের দ্বিতীয় সংসারের ছেলে জজ মিয়ার জন্ম ঢাকার তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়া এলাকায়। বাবার ভাঙারি (স্ক্র্যাপ মালের) ব্যবসার সুবাদে তারা পরিবারের সবাই প্রথমে সেখানকার তিব্বত বস্তি এবং পরে নাখালপাড়া নূরানী মসজিদের পাশে থাকত। ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয় জজ মিয়ারা তিন ভাই, দু বোন।

ব্যবসার সামান্য আয় দিয়ে সংসার চালানোর পাশাপাশি বাবা আবদুর রশিদ জজকে নাখালপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করান। ওই স্কুল থেকে পঞ্চম শ্রেণি পাস করে জজ। পরে তাকে স্থানীয় মনু মিয়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ে ভর্তি করা হয়। ভর্তির কিছুদিন পরই জজের বাবা আবদুর রশিদ গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। এরপর আর লেখাপড়া হয়নি তার। বড় ভাই আলমগীরসহ বাবার ভাঙারি ব্যবসা দেখাশোনা শুরু করে জজ।

বীরকোট গ্রামের বর্তমান ইউপি সদস্য জামাল উদ্দিন জানান, জজ বড় হয়েছে ঢাকায়। সাত-আট বছর আগে তারা সপরিবারে গ্রামের বাড়িতে আসে। কখনো কারও সঙ্গে তার ঝগড়া-বিবাদ হয়নি। এলাকার সবার কাছে সে ভালো ছেলে হিসেবে পরিচিত। কেশারফা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আবুবকর ভুঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, সে সন্ত্রাসী ছিল না। ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আবু ইউসুফ মজুমদারও একই কথা বলেন।

জানা গেছে, ঢাকা থেকে সিআইডির অনুরোধ পেয়ে সেনবাগ থানা-পুলিশ জজ মিয়াকে গ্রেপ্তারের জন্য এলাকার গ্রাম পুলিশ মোকছেদকে সোর্স নিয়োগ করে এবং পাওয়ামাত্র তাকে আটক করতে বলে। সে অনুযায়ী বীরকোট গ্রামেরই বাসিন্দা মোকছেদ ৯ জুন বেলা ১টার দিকে জজকে আটক করে থানায় খবর দেয়। এরপর এএসআই আবদুল কবিরের নেতৃত্বে একদল পুলিশ তাকে সেখান থেকে থানায় নিয়ে আসে।

সেনবাগ থানার এএসআই আবদুল কবির প্রথম আলোকে জানান, জজ মিয়াকে তিনি নিজে গ্রেপ্তার করে সিআইডির হাতে দিলেও সে যে এত বড় মাপের সন্ত্রাসী তা আগে বুঝতে পারেননি।

প্রথম আলো, ২৯ জুন ২০০৫