বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেশি হয়। বর্ষা শেষ হয়েছে, তবু ডেঙ্গু উদ্বেগজনক পর্যায়ে রয়ে গেছে।
শীত এসে গেছে। তবু প্রতিদিন দেড় থেকে দুই হাজার মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। ডেঙ্গুতে নিয়মিত মৃত্যুও হচ্ছে। জনস্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ ও মৃত্যু কিছুটা কমে এলেও গত বছরের তুলনায় তা এখনো বেশি। এই পরিস্থিতি উদ্বেগের কারণ হয়ে থাকবে।
ডেঙ্গু বাংলাদেশের জন্য নতুন বড় ধরনের জনস্বাস্থ্য সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। গত সোমবার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ পোলিও, ধনুষ্টংকার, কালাজ্বর ও গোদ রোগ নির্মূল করেছে। এর স্বীকৃতিও দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিন্তু তিনি একবারও ডেঙ্গুর বিষয়ে কোনো কথা বলেননি।
তিন লাখের মতো মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হবেন, চৌদ্দ শর বেশি মানুষ মারা যাবেন—বছরের শুরুতে এটা কেউ ভাবেননি। তা ছাড়া এ বছর ঢাকা শহরের চেয়ে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুতে বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন, এমন এর আগে কখনো হয়নি।
এক দিনে বা এক বছরে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। কয়েক বছরের চেষ্টায় আমরা হয়তো ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব। তবে এখনই দেশব্যাপী সমন্বিত কার্যক্রম শুরু করতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।মুশতাক হোসেন, জনস্বাস্থ্যবিদ
গতকাল মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার অ্যান্ড কন্ট্রোল রুমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় (সোমবার সকাল ৮টা থেকে মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত) সারা দেশে ১ হাজার ৮৯৫ জন নতুন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা হলো ২ লাখ ৮৩ হাজার ৫৯৩। অধিদপ্তর আরও বলছে, সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৮ জন। এ নিয়ে এ বছর ডেঙ্গুতে ১ হাজার ৪২৫ জনের মৃত্যু হলো।
পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এ বছর আর বৃষ্টি না হলে, শীত বাড়তে থাকলে ডেঙ্গুর সংক্রমণ কমে আসবে। বৃষ্টির পানি না থাকলেও এডিস মশার বংশবিস্তারের মতো পানি বহু জায়গায় আছে। সুতরাং ডেঙ্গুও থাকবে।
গত বছর ৭ নভেম্বর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৮৭৫ জন। এ বছর একই তারিখে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৮৯৫ জন; অর্থাৎ একই সময়ে এ বছর ১ হাজার রোগী বেশি। এসব রোগীর বেশির ভাগই ঢাকা শহরের বাইরের।
ডেঙ্গুর সংক্রমণ কিছুটা কম দেখা যাচ্ছে। মৃত্যুও কমে এসেছে। সংক্রমণ ও মৃত্যু কমে আসার এই প্রবণতা ঢাকা শহরে ও ঢাকা শহরের বাইরে সারা দেশে দেখা যাচ্ছে। জনস্বাস্থ্যবিদেরা বলছেন, আবার বৃষ্টি না হলে সংক্রমণ কমে আসার এই ধারা অব্যাহত থাকবে।
গত মাস; অর্থাৎ অক্টোবরের প্রথম সাত দিনে সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ১৭ হাজার ৪১৬ জন। চলতি মাসের প্রথম সাত দিনে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১২ হাজার ৪১৮ জন; অর্থাৎ মাসের প্রথম সাত দিনের হিসাবে প্রায় ৫ হাজার রোগী কম ভর্তি হয়েছেন। ডেঙ্গুতে মৃত্যুর ক্ষেত্রেও এমন দেখা গেছে। অক্টোবরের প্রথম সাত দিনে ৯০ জনের মৃত্যু হয়েছিল। আর নভেম্বরে প্রথম সাত দিনে মৃত্যু হয়েছে ৭৭ জনের।
১৫ অক্টোবর থেকে ৪ নভেম্বর পর্যন্ত তথ্য পর্যালোচনা করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রতিবেদন বলছে, সংক্রমণ ও মৃত্যু কমছে।
গত শতাব্দীর ষাটের দশকে এ দেশে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। এরপর ২০০০ সালে প্রথম বড় আকারে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ডেঙ্গু ছিল মূলত ঢাকা শহরকেন্দ্রিক। এরপর প্রতিবছর কমবেশি ডেঙ্গুর সংক্রমণ দেখা দিতে থাকে। তবে ডেঙ্গু বড় বড় শহরেই সীমাবদ্ধ ছিল। ২০১৯ সালে বড় বড় শহরের পাশাপাশি কয়েকটি গ্রামেও ডেঙ্গু শনাক্ত হয়।
এ বছর ঢাকা শহরের বাইরে ১ লাখ ৮১ হাজার ৬৩২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে কেবল বরিশাল বিভাগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৩৪ হাজার ১৮০ জন। উপকূলের জেলাগুলোতে ডেঙ্গুর প্রকোপ নতুন ঝুঁকি বলে মনে করছেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা।
এ বছর ৬৪ জেলাতেই ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছে, বহু গ্রামের মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এর অর্থ, সারা দেশে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা আছে।
মশা নিয়ন্ত্রণ কর্মকাণ্ড সাধারণত বড় বড় শহরে চোখে পড়ে। গ্রামে সেই কর্মকাণ্ড নেই। গ্রামের মানুষের করণীয় সম্পর্কে সরকারের পক্ষ থেকে স্পষ্ট কোনো বার্তা নেই। গ্রামে তাই ডেঙ্গুর ঝুঁকি থেকেই যাবে বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদেরা।
একটি দেশে বা অঞ্চলে একবার ডেঙ্গু দেখা দিলে তা আর যায় না, ফিরে ফিরে আসে। তবে প্রতিরোধের ব্যবস্থা নিলে, বিশেষ করে মশকনিধন কর্মকাণ্ড হাতে নিলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা যায়—এমন বহু নজির আছে। জনস্বাস্থ্যবিদের বলছেন, বাংলাদেশ থেকে ডেঙ্গু একেবারে নির্মূল হবে না। তবে ঠিক সময়ে সঠিক ব্যবস্থা নিলে এ বছর ডেঙ্গু এতটা ছড়াত না।
গত বছর ৭ নভেম্বর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ৮৭৫ জন। এ বছর একই তারিখে ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ৮৯৫ জন; অর্থাৎ একই সময়ে এ বছর ১ হাজার রোগী বেশি। এসব রোগীর বেশির ভাগই ঢাকা শহরের বাইরের।
জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন বলেন, ‘এক দিনে বা এক বছরে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। কয়েক বছরের চেষ্টায় আমরা হয়তো ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনতে পারব। তবে এখনই দেশব্যাপী সমন্বিত কার্যক্রম শুরু করতে হবে। তা না হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।’