বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, বাসযোগ্য শহর গড়া খরচের ব্যাপার নয়, সুশাসনের ব্যাপার। শহরকে বাসযোগ্য করতে স্বল্প খরচে যেসব সমস্যার সমাধান করা যায়, সেগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয় না। তিনি বলেন, শহর বাসযোগ্য করা, গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনার সঙ্গে খরচ নয়, সুশাসন জড়িত।
গতকাল শনিবার ‘স্থায়িত্বশীল নগরায়ণ: সমস্যা ও সমাধান’ শীর্ষক সম্মেলনের সমাপনী পর্বে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ এ কথা বলেন। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্কের (বেন) যৌথ উদ্যোগে রাজধানীর খামারবাড়ির বাংলাদেশ কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘আমরা হাজার হাজার কোটি টাকার প্রকল্প করতে পারি, কিন্তু সহজ সমাধান করতে পারি না। এত বড় এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বানাচ্ছি হাজার কোটি টাকা দিয়ে, কিন্তু যেকোনো অন্য বড় শহরে ঢাকার মতো গণপরিবহন যত্রতত্র থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করে না। এটা তো কোনো খরচের ব্যাপার না, এটা সুশাসনের ব্যাপার।’
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আরও বলেন, নদী দখলমুক্ত, পরিবেশকে সুরক্ষা ও সুশৃঙ্খল গণপরিবহনের মাধ্যমে পুরো দেশকে বাসযোগ্য করা ওই সব এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের চেয়ে অনেক বেশি জরুরি ছিল। স্বল্প খরচের সমাধান যেগুলো শুধু সুশাসনের বিষয়, সেগুলোতে অগ্রাধিকার না দিয়ে অনেক বড় বড় প্রকল্প হয়। এগুলোর দরকার আছে, কিন্তু সেগুলোর মধ্যে অগ্রাধিকার থাকতে হবে। খরচের সাশ্রয় করতে হবে।
পরিবেশবান্ধব ও বাসযোগ্য শহর প্রসঙ্গে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, দেশের শহরগুলোতে যদি বাসযোগ্যতার সূচক করা হয়, তাহলে জবাবদিহি তৈরি হবে, স্থানীয় কর্তৃপক্ষের মধ্যে একটি প্রতিযোগিতা গড়ে উঠবে। শহর টেকসই ও পরিবেশবান্ধব হচ্ছে কি না, নগরবাসীর জীবন সুখকর হচ্ছে কি না, সেটাও জানা যাবে।
বাপা ও বেনের এই সম্মেলনে উদ্বোধনী এবং সমাপনীসহ দিনব্যাপী ছয়টি অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে বিশেষজ্ঞরা নিজেদের উপস্থাপনা তুলে ধরেন। প্রস্তাব গ্রহণ পর্বে বাপার সহসভাপতি ইকবাল হাবিব জানান, এই সম্মেলনে যেসব প্রস্তাব এসেছে, সেগুলোর ওপর তাঁরা আগামী তিন মাস অংশীজনদের নিয়ে কর্মশালা করবেন। সেখান থেকে আসা সুপারিশ ও প্রস্তাব নীতিনির্ধারকদের কাছে পাঠানো হবে।
সমাপনী পর্বে বাপার যুগ্ম সম্পাদক অধ্যাপক আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদারের সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য দেন বাপার সহসভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম, বেন-এর বৈশ্বিক সমন্বয়ক অধ্যাপক মো. খালেকুজ্জামান। এ ছাড়া ধন্যবাদ জানান বাপার কোষাধ্যক্ষ জাকির হোসেন ও বেন-এর নিলুফার জাহান।
সমাপনী পর্বের আগে বাপা ও বেনের আরেকটি অধিবেশন ছিল গণপরিসর ও নাগরিক অধিকার নিয়ে। সেখানে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, যেকোনো নগরের মেরুদণ্ড হওয়া উচিত তার গণপরিবহন। এর জন্য প্রথমে প্রয়োজন ফুটপাত, এরপর বাস ও মেট্রো। বাংলাদেশে বাস যেটা চলছে, সেটা কোনো বাসসেবা নয়। আবার শহরের ফুটপাতও মুক্ত নয়। এই কাজগুলো সমন্বিতভাবে করার কথা ছিল; কিন্তু সেই জবাবদিহি ও সুশাসন নেই।
বাস ব্যবস্থাপনা প্রসঙ্গে শামসুল হক বলেন, বাসভিত্তিক গণপরিবহনে চরম বিশৃঙ্খলা চলে। এই বিশৃঙ্খলা করেও একটা শ্রেণি সুবিধাভোগী হচ্ছে। বাসভিত্তিক গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে বড়জোর ছয় মাস লাগবে। কিন্তু এখানে দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা। কারণ, যারা সুবিধাভোগী, তারা সুশৃঙ্খল হতে চাইবে না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, রাজউকের চেয়ারম্যান আইনের বলে ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করে দিতে পারেন; কিন্তু আসলে তা পারা যায় না। মূলত তিনি ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তনের অনুমতি দিতে পারেন। কিন্তু রাজউক জলাশয়কে কীভাবে ভূমি দেখাবে? ইকোসিস্টেম তো বদলাতে পারে না। রাজউকের চেয়ারম্যানের এই ক্ষমতা রহিত করা দরকার।
এই পরিবেশবাদী আইনজীবী বলেন, ঢাকা শহরের কোনো ভিশন নেই। এখানে আর আইনের দরকার নেই। এখন সব সংস্থার সমন্বয়ে আইনের যথাযথ প্রয়োগ দরকার। রাজউকের ১৯৫৩ সালের আইন দিয়ে ২০২৪ সালকে মোকাবিলা করা যাবে না। তাদের আইনে জলাশয়, পরিবেশ শব্দ নেই। এগুলো যুক্ত করতে হবে। রাজউকের বোর্ডেও পরিবর্তন আনার কথা বলেন তিনি। এ ছাড়া বলেন, সরকারের ভূমির খতিয়ানকে অনলাইনে আনতে হবে, যেন সবাই তা দেখতে পায় এবং স্বচ্ছতা থাকে।
ভূমি ব্যবস্থাপনা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম এম আকাশ বলেন, সমাধান কী, সবাই সেটা জানে। কিন্তু অতিধনী যাঁরা, তাঁরা সমাধানের পক্ষে নন, শাসকশ্রেণি ও তাদের অনুগত প্রশাসনও এর পক্ষে নয়। এ জন্য জনগণ ও মধ্যবিত্ত শ্রেণিকে সচেতন হয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
সম্মেলনের এই অধিবেশনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও বাপার সহসভাপতি আতিউর রহমানের সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য দেন স্থপতি সালমা এ শফি, বুয়েটের অধ্যাপক ইসরাত ইসলাম প্রমুখ।