প্রতি মাসে দাম নির্ধারণ করে দেয় বিইআরসি। তবে গৃহস্থালির জন্য গ্যাস কখনোই নির্ধারিত দামে পাওয়া যায় না।
দেশে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) ব্যবহার করা হয় মূলত বাসাবাড়িতে রান্নার কাজে। পরিবহনেও এর সামান্য ব্যবহার রয়েছে। প্রতি মাসে এলপিজির সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। তবে এই দরে গৃহস্থালির রান্নার জন্য দেশের কোথাও এলপিজি পাওয়া যায় না। নানা অজুহাতে বাড়তি দাম রাখা হচ্ছে এলপিজির সিংহভাগ এই ভোক্তাদের কাছ থেকে।
চলতি মাসে বেসরকারি খাতে ১২ কেজি সিলিন্ডারের এলপিজির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ হাজার ৪২২ টাকা। এর সঙ্গে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার নামে ৫০ টাকা যুক্ত করেন খুচরা বিক্রেতারা। এতে দাম হওয়ার কথা ১ হাজার ৪৭২ টাকা। তবে ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন শহরে এটি বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৬৫০ টাকায়।
সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে গ্যাস সরবরাহকারী কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস কিনতে হয়, এটাই মূল সমস্যা।তোবারক হোসেন, খুলনা এলপিজি গ্যাস দোকান মালিক সমিতির সভাপতি
গতকাল শনিবার ঢাকার মোহাম্মদপুর ও মিরপুর এলাকার কয়েকটি দোকানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কিছুদিন ধরে বাজারে এলপিজি সিলিন্ডারের সরবরাহের সংকট রয়েছে। তাই দামও বেশি। নির্ধারিত দামে তাঁরা কখনোই পান না, তাই ভোক্তার কাছেও বেশি দাম রাখতে হয়। টোলারবাগের রূপা ট্রেডার্সের একজন বিক্রেতা বলেন, ১২ কেজির সিলিন্ডার বিক্রি করছেন ১ হাজার ৬০০ টাকায়। তবে বসুন্ধরার এলপিজির দাম ১ হাজার ৬৫০ টাকা।
গৃহস্থালি ভোক্তাদের অভিযোগ, সংকটের কথা বলে ইচ্ছেমতো দাম নিচ্ছেন দোকানিরা। রায়েরবাজারের বাসিন্দা তামান্না আক্তার বলেন, বাসায় গ্যাসের লাইন থাকলেও দিনের বেশির ভাগ সময় গ্যাস পাওয়া যায় না। অথচ নিয়মিত বিল দিতে হয়। আবার বিকল্প হিসেবে এলপিজি ব্যবহার করতে গিয়ে বাড়তি খরচ করছেন। তা–ও কখনো নির্ধারিত দামে পাওয়া যায় না।
বিইআরসির দাম সমন্বয়ের সূত্রে কিছু বিষয় ধরা হয়নি। গত দেড় বছরে জ্বালানি তেল, বিদ্যুতের দাম অনেক বেড়েছে। জাহাজভাড়া বেড়েছে। এসব খরচ সমন্বয় করা না হলে নির্ধারিত দামে বাজারে এলপিজি পাওয়া কঠিন। নতুন করে শুনানি ডেকে হলেও দাম সমন্বয়ের সূত্র যৌক্তিক করতে হবে।জাকারিয়া জালাল, এলপিজি খাতের শীর্ষ ব্যবসায়িক কোম্পানি বসুন্ধরা এলপি গ্যাসের হেড অব সেলস
কয়েক বছর ধরে দেশে নতুন করে পাইপলাইনের মাধ্যমে গ্যাসের সংযোগ দেওয়া বন্ধ রয়েছে। এতে রাজধানীসহ দেশের বড় একটি অংশের মানুষ এলপিজি গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। দিন দিন বড় হচ্ছে এলপিজি গ্যাসের বাজার।
রাজশাহীতে পরিবেশকেরা বলছেন, তাঁরা বেশি দামে সিলিন্ডার কিনছেন। তাই বাড়তি দামে বিক্রি করছেন। নগরের একটি পরিবেশক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক আকাশ সাহা বলেন, বারবার সরকার নতুন দাম নির্ধারণ করে। সেই দামে তাঁরা সিলিন্ডার কিনতে পারেন না। তাঁরা এবার কিনেছেন ১ হাজার ৪৭৫ টাকায়।
সিলেটে ১২ কেজির একটি সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার ৬০০ থেকে ১ হাজার ৬৫০ টাকায়। বন্দরবাজারের মাখন মিয়া চুলাঘরের ব্যবসায়ী মো. আখতারুজ্জামান বলেন, নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে তাঁদের সিলিন্ডার গ্যাস কিনতে হয়।
গ্যাসের দাম বাড়লে টের পাওয়া যায় উল্লেখ করে খুলনার টুটপাড়া এলাকার গৃহিণী মলিনা মণ্ডল বলেন, কমলে কিন্তু খুব একটা টের পাওয়া যায় না।
খুলনা এলপিজি গ্যাস দোকান মালিক সমিতির সভাপতি তোবারক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে গ্যাস সরবরাহকারী কোম্পানির কাছ থেকে গ্যাস কিনতে হয়, এটাই মূল সমস্যা।
চট্টগ্রাম নগরের বাসিন্দা খোরশেদ আলম বলেন, বাজারে সবকিছুর দাম বাড়তি। এর মধ্যে এলপিজিও কিনতে হচ্ছে বাড়তি দামে।
গণশুনানি করে ২০২১ সালের এপ্রিলে প্রথম এলপিজির দাম নির্ধারণ করে বিইআরসি। এরপর প্রতি মাসের শুরুতে দাম সমন্বয় করা হচ্ছে। বিইআরসি সূত্র বলছে, আগে ইচ্ছেমতো দাম নিতেন ব্যবসায়ীরা। তাই বিইআরসির দাম নির্ধারণের শুরু থেকেই কিছু খরচ ধরা হয়নি বলে আপত্তি জানান এ খাতের ব্যবসায়ীরা। এরপর তা আমলে নেয় কমিশন। গত বছর ডলারের দাম বাড়তে থাকলে তোলা হয় নতুন আপত্তি। এরপর এটিও আমলে নিয়ে দাম সমন্বয়ের সূত্র সংশোধন করে কমিশন। ডলারের বাংলাদেশ ব্যাংকের দর ধরে হিসাব না করে আমদানি ঋণপত্রের গড় দর হিসাব করা হয়। এখন নতুন কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা। তাঁদের দাবি, আমদানি করা জাহাজের পরিবহন খরচ অনেক বেড়ে গেছে। ইতিমধ্যে প্রমাণ হিসেবে তাঁরা কমিশনে কিছু কাগজপত্রও জমা দিয়েছেন।
এলপিজি ব্যবসায়ীদের সংগঠন এলপিজি অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (লোয়াব) বলছে, এলপিজি মূলত একটি আমদানিনির্ভর পণ্য। এটি তৈরির মূল উপাদান প্রোপেন ও বিউটেন বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হয়। নানা কারণে খরচ ওঠানামা করে। আর বিশ্ব জ্বালানি বাজারে এখন একধরনের অস্থিরতা চলছে। জাহাজের ভাড়াও অনেক বেড়ে গেছে।
এলপিজি খাতের শীর্ষ ব্যবসায়িক কোম্পানি বসুন্ধরা এলপি গ্যাসের হেড অব সেলস জাকারিয়া জালাল প্রথম আলোকে বলেন, বিইআরসির দাম সমন্বয়ের সূত্রে কিছু বিষয় ধরা হয়নি। গত দেড় বছরে জ্বালানি তেল, বিদ্যুতের দাম অনেক বেড়েছে। জাহাজভাড়া বেড়েছে। এসব খরচ সমন্বয় করা না হলে নির্ধারিত দামে বাজারে এলপিজি পাওয়া কঠিন। নতুন করে শুনানি ডেকে হলেও দাম সমন্বয়ের সূত্র যৌক্তিক করতে হবে।
নির্ধারিত দামে এলপিজি বিক্রি নিয়ে গত ৮ ফেব্রুয়ারি বিইআরসি, এলপিজি ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, ভোক্তা প্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। বাজারে নজরদারি বাড়িয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়েছে। তবে বাজারে এর প্রতিফলন নেই। অবশ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে নির্ধারিত দামেই পেট্রলপাম্পগুলোতে এলপিজি বিক্রি হয়।
বিইআরসির সদস্য (পেট্রোলিয়াম) মো. কামরুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বিইআরসি নির্ধারিত দামের চেয়ে বাড়তি দাম রাখার কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে। এবারও দাম নির্ধারণের সময় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা জাহাজ খরচ বেড়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। এটি যাচাই করে দেখা হচ্ছে। নতুন করে শুনানি করা হতে পারে।
[প্রতিবেদনে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি, খুলনা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও সিলেট]