এই প্রথম ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দীর্ঘস্থায়ী কৌশল হাতে নিচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কৌশলপত্র দুর্বল।
বাংলাদেশ জাতীয় ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ খসড়া কৌশলপত্রে (২০২৪–২০৩০) দেশকে ডেঙ্গুমুক্ত করার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করা হয়েছে। জানুয়ারির (২০২৪) শুরু থেকে এই কৌশলপত্র ধরে কাজে নেমে পড়তে চাইছে স্বাস্থ্য বিভাগ। জনস্বাস্থ্যবিদ ও কীটতত্ত্ববিদেরা বলছেন, কৌশলপত্র দুর্বল। ব্যাপকভিত্তিক আলোচনার পর কৌশলপত্র চূড়ান্ত করার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা।
দেশজুড়ে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই জাতীয় ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কৌশলপত্র তৈরি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র (সিডিসি)। খসড়া কৌশলপত্র নিয়ে ১৪ ডিসেম্বর রাজধানীর একটি হোটেলে আলোচনা হয়। তাতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কোনো প্রতিনিধি ছিলেন না। গণমাধ্যমের কোনো প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। খসড়া কৌশলপত্রে কী আছে, সে ব্যাপারে বক্তব্য দিতে রাজি হননি স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
তবে সরকারের রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির বিষয়ভিত্তিক পরিচালক অধ্যাপক মো. নাজমুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘খসড়া কৌশলপত্র মহাপরিচালকের টেবিলে আছে। তিনি দেখে দিলে সেটি আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠাব। আমরা ওই কৌশলপত্র ধরে জানুয়ারির শুরু থেকেই কাজ আরম্ভ করতে চাইছি।’
২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন ও মারা গেছেন। বছরজুড়েই ডেঙ্গুর আতঙ্ক কমবেশি মানুষের মধ্যে কাজ করেছে। এ বছর এ পর্যন্ত ৩ লাখ ২০ হাজার ৪৬০ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। এর মধ্যে মারা গেছেন ১ হাজার ৬৯৭ জন। সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় (শনিবার সকাল আটটা থেকে রোববার সকাল আটটা পর্যন্ত) ডেঙ্গুতে মারা গেছেন চারজন। এত আক্রান্ত ও মৃত্যু দেশের ইতিহাসে আর কখনো হয়নি।
গত শতাব্দীর ৬০ দশকে এই ভূখণ্ডে প্রথম ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। সে সময় একে ‘ঢাকা ফিবার’ নাম দেওয়া হয়েছিল। ২০০০ সালে ডেঙ্গুর বড় ধরনের প্রকোপ দেখা দেয়। এরপর থেকে প্রায় প্রতিবছর মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে, কোনো কোনো বছর মানুষের মৃত্যু বেশি হয়েছে। তবে সব সময় দেখা গেছে, বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর সংক্রমণ বাড়লেই সরকার নড়েচড়ে বসে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ডেঙ্গু নিয়ে দীর্ঘ মেয়াদে পরিকল্পনার পরামর্শ দিলেও সরকার তা শোনেনি। এই প্রথম ছয় বছর মেয়াদে (২০২৪–২০৩০) কাজ করার কথা বলছে স্বাস্থ্য বিভাগ। এটাকে ইতিবাচক বলে অনেকেই মনে করছেন।
৫০ পৃষ্ঠার কৌশলপত্রের শুরুতেই আছে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের বাণী। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আগামী বছর ডেঙ্গুর সংক্রমণ বৃদ্ধির আশঙ্কা করলেও কৌশলপত্রে ২০৩০ সালের মধ্যে ডেঙ্গু কমিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ২০৩০ সাল নাগাদ ডেঙ্গুর সংক্রমণ প্রতি লাখ মানুষে ১০০–এর নিচে নামিয়ে আনা হবে। তবে স্বাস্থ্য বিভাগের মূল লক্ষ্য দেশকে ডেঙ্গুমুক্ত করা।
শুরুর দিকে দেশে ডেঙ্গুর ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতি বর্ণনা করার পর খসড়ায় ছয়টি কৌশল বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে আছে চিকিৎসক, নার্স ও অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি, সমন্বিত কীট ব্যবস্থাপনাকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, ডেঙ্গু পর্যবেক্ষণব্যবস্থা ও বাস্তব সময়ে তথ্য দেওয়ার পদ্ধতি শক্তিশালীকরণ, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর কাজের সমন্বয়, টিকা উদ্ভাবনসহ গবেষণাকাজ বাড়ানো এবং টাস্কফোর্স গঠনসহ বহুপক্ষের কাজের সমন্বয়। প্রতিটি কৌশল করার পাশাপাশি তা কী করে বাস্তবায়ন করা হবে, তা বিস্তারিত ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে।
কৌশলপত্রে উল্লেখ করা লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জন করা সম্ভব হবে না বলে মন্তব্য করেছেন জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে–নজির আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গ্রামগঞ্জে ডেঙ্গু মশা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হবে, তা কৌশলপত্রে পরিষ্কার করে বলা হয়নি। গ্রামে মশা নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার কী করবে, কীভাবে করবে, কীভাবে মানুষকে ওই কাজে সম্পৃক্ত করা হবে, তা কৌশলপত্রে স্পষ্ট করা হয়নি।
বিশেষজ্ঞরা বহু বছর ধরে বলে আসছেন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কীটতত্ত্ববিদদের বড় ভূমিকা আছে। কিন্তু ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে তাঁদের বড় ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে না। কৌশলপত্রে বলা হয়েছে, বিভাগীয় পর্যায়ে প্রতিটি সিভিল সার্জন কার্যালয়ে এবং প্রতিটি উপজেলায় কীটতত্ত্ববিদ নিয়োগ দেওয়া হবে।
কৌশলপত্রে বেশ কিছু দুর্বলতা আছে বলে মন্তব্য করেছেন কীটতত্ত্ববিদ ও জাতীয় নদী কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরী। তিনি বলেন, এখন বছরজুড়ে ডেঙ্গু দেখা যাচ্ছে, কিন্তু শীতকালে এডিস ও কিউলেক্স মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বয় কীভাবে হবে, তার উল্লেখ এতে নেই। মশা বা কীট নিয়ন্ত্রণে যন্ত্রের ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু কৌশলপত্রে সেসবের কোনো উল্লেখ নেই।
এ রকম আরও বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি বিষয় পূর্ণাঙ্গভাবে কৌশলপত্রে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। আবার সফল হতে দেখা যায়নি, এমন কিছু বিষয়ও বাস্তবায়নের কথা এতে বলা হয়েছে। হাতে নেওয়া কৌশলগুলো ঠিকভাবে কাজ করছে কি না, তা জানা বা যাচাই করার কোনো কথা কৌশলপত্রে নেই। এই কৌশলপত্র বাস্তবায়নের চেষ্টা চললে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না।
এই দুই জনস্বাস্থ্য ও কীটতত্ত্ববিদ বলছেন, সরকারের উচিত খসড়া কৌশলপত্র প্রকাশ করা এবং বিভিন্ন বিষয়ের বিশেষজ্ঞদের মতামত অন্তর্ভুক্ত করে তা চূড়ান্ত করা।